ভ্রান্তিবিলাস কিংবা সোনা-মাছ এর স্মৃতিভ্রম

একঃ
কী বলবো? কী বলবো ভাইজান? দিনের প্যাডেল মারতে মারতে, চালাতে চালাতে নিত্য ভাবনাটা ফুলে-ফেঁপে গল গল গড়াচ্ছে, আগুনের আঁচে য্যান ভাতের ফ্যান!
মিতালী আজও এল, আহারে! ইশ্রে! ফাঁদ ভাইজান, ফাঁদ। জানো, কী যে এক জাল, ছাড়ানো তো দূর, ফাঁক-ফোকর পাচ্ছেই না মেয়েটা – ডানা ঝাপটাবে, হাহ্!

ক’দিন ঘুরতে না ঘুরতেই কোন্ মাছ যেন সব ভুলে-মুছে-চেপে-ঢেকে স্মৃতি ধামাচাপা দেয়? গোল্ড-ফিশ, আহা বাংলায় কী সুন্দর দাঁড়ায় গো শব্দটা সেজে-গুজে, সোনা-মাছ।
‘লক্ষ্মী সোনা, বাপের কাছ থেকে টাকাটা আমায় এনে দাও।’ – কথার ধারে মিতালীর সোনা-সোনা শ্যামরঙা মুখ কেমন চুপসে ফাটা বেলুন। আমরা তো বেলুন-ওড়া দুর্দান্ত কৈশোর দেখেছি ঘোরে-বেঘোরে স্কুল পালিয়ে-কাটিয়ে। সুবর্ণ বেশ পুরুষ-পুরুষ হয়ে উঠছে বুঝি আজকাল?

গাঢ় সন্ধ্যায় আমি মিতালীকে পড়ি, পড়তেই থাকি। মিতালী ছেঁড়া-ফাটা-ছিন্নভিন্ন-ঝাঁঝরাও। মিতালী কাজল ছুঁতে ভয় পায়। সুবর্ণ যে জানে কাজল আর মিতালীর গভীর দু’চোখ কী নিবিষ্ট প্রেমমগ্ন, নেশা-জাগানিয়া!
‘জানিস্ বেশ্যা হয়ে আছি। ও চাইলে আমায় দিতেই হবে। আমি চাইলে ওকে খুঁজেই পাইনে কোথাও।’ – মিতালীর উচ্চারণের ছাপ ওর চোখে ভেসে ওঠে, চোখ যেন বায়স্কোপ, যেন পুঁথি পাঠ চলে কোনো আসরে। আর একের পর এক দৃশ্য দেখে চলা, সুবর্ণ-মিতালীর ঘর-ভাবনা, আমি দর্শক!
মিতালী বিয়ের নেশায় পাগলপারা হয়ে ঠিক ঠিক তিন বছর আগে করেই বসলো বিয়েটা। যদিও অন্য একটা পরিবারের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার বাড়তি ঝামেলা ছাড়া নতুন কিছুর স্বাদ পেল না। একসাথে থাকাথাকিটাতো নতুন নয় ওদের জন্যে। বরঞ্চ সূবর্ণর এই পরিবর্তন ভাঙা ভাঙা বিপন্নতা নিয়ে এল। বউয়ের উপর দাবীটাকে কয়েক গন্ডা বাড়িয়ে বউয়ের হাতখরচ, বউয়ের বাবার বাড়ি-গাড়ি-টাকায় নিজের দাবীর ব্যাপারে বেশ সচেতন হয়ে উঠলো সূবর্ণ।

এবং অতঃপর ঘরটা অ্যাকুরিয়াম হয়ে উঠলে মিতালীকে আমি সোনা-মাছ হতে দেখেছি। ধুলো জুটিয়ে সযতনে ঢেকেছে মিতালী ধল-প্রহরের কান্না।
‘মিতালী’কে ভুলিয়ে বুঝিয়ে পুতুল-পুতুল সাজিয়ে নৈবেদ্যর থালে সন্তর্পণে বসেছে মিতালী – ঠোঁট হেসেছে, চোখ জ্বলেছে যার। তবু সোনা-মাছ ফাঁদ পেরোবার পথে পালায় না। জীবনের তীব্র মাদকতা, টেনে দিয়েছে না পেরোবার সীমানা – চেনা শরীরের ঘ্রাণ! কিন্তু শুধু কী তাই? নির্ভরতা না অপমান। নিজের সিদ্ধান্তকে অন্যের চোখে খাটো হতে দেখার ভয় – অপমান। না কী আশ্রয়! স্কুল-কলেজ-এমবিএ পাশ মিতালীর খুব কি অভাব হতো ভাইজান নিরাপত্তার?

মিতালী তখন একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। চা খেতে-খেতে, আড্ডা দিতে-দিতে আমরা ভাবি – ঘর-পালানো, স্কুল-পালানো মিতালী বৃত্ত ভাঙার সাহস পায় না কি করে?
মিতালীকে শুনতে-শুনতে, বুঝতে-বুঝতে আমার কেবল, কেবলই আমার মা-কে বোঝা হয়ে ওঠে ভাইজান।

দুইঃ
মায়ের সত্যি নিজস্ব কোন ঘর ছিল না কখনও। গোধূলি পেরোনো অবকাশে কিছু লিখতে বলা হলে কী ই বা লিখে ওঠা হতো তাঁর। ঠিক-ঠিক সব ঠিক হয়ে এল – ভাবতে থাকার দ্বন্দ্বে ডুবে চল্লিশোর্ধ্ব বৎসরের দিন-পরিক্রমা। কর্তৃত্বের অহম্ বড্ড লোভনীয় এক বস্তু, তাই বাবারও ততদিনে মা-কে চিরে-কেটে-খুঁড়ে দেখা শেষ।

জানো না, তুমি জানো না ভাইজান, মায়ের মাঝেও তরতাজা এক সোনা-মাছ বসত করে চুপিসারে, ভেতরঘরে।
শিল-নোড়ায় ভর্তা পেষা শেষে, টুং-টাং চুড়ি বাজানো হাতে মাখা ভাত খেতে খেতে কী সন্তুষ্ট এক মা-কে দেখি। ঘর গোছাতে থাকা মা, পিঠা বানাতে থাকা মা, জায়নামাজে ঝিম-গ্রস্ত মা। মুহূর্ত-মুহূর্ত, দিন-দিন, স্বেচ্ছাশ্রমে স্মৃতিভ্রষ্ট সোনা-মাছ মা আমার!

ভাইজান, মনে পড়ে ভাইজান, কার্তিকের নিস্তব্ধ দুপুর, স্কুল শেষের ক্লান্তি মেখে কী দারুণ চুপচাপ! আর মা-এর ফোঁপানো যন্ত্রণায় ভেঙে ভেঙে পড়ছে সমগ্র সত্তা। মা-র চাকরী করা, থিয়েটার-মহড়া সব থামাতেই হবে। মায়ের সন্ধ্যা-শেষের আড্ডাটাও বন্ধ। বাবার সে কী কঠিন আদেশ। কী প্রচণ্ড দমবন্ধ অনুভবে কাঁপছি দুজনে – ভয়ে। কী বিপন্ন এক বোধে! আর ভেসে যাচ্ছে ঘর, দুটো মানুষের খোলস সাঁটা সংসারের বিষে। কী বিভ্রান্ত অবগাহনে জেনে নিয়েছিলাম ক’মাস পরপর মার্ মার্ কাট্ কাট্ মুহূর্তদের বেমালুম চেপে-ঢেকে ভুলে বসতে জানে মানুষগুলো।

আজও মনে আছে, কড়া রোদ ডিঙিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার খেলায় জিতে যাওয়া আমি তোমার চোখের দিকে তাকানোর স্পর্ধা পেতাম না সেসব দিনে। মনে হতো যেন পুড়িয়ে দিতে চাইছো – প্রতিবেশীদের প্রশ্ন, বুয়ার অহেতুক কৌতূহল, দিদা-দাদুর দুশ্চিন্তা আর, আর আমার প্রচণ্ড ভয়টাকেও। কী গাঢ় স্বরে বলতে – ‘সব মানুষ আর তুই কি তা এ্যাক নি? অতো ডরাইবার কি তা আছে?’

তিনঃ
জানো ভাইজান, গেল বৃহস্পতি, ডুবে গেলাম - ভেসে গেলাম - উড়ে গেলাম আর মরে গিয়েছিলাম একবার। কয়েকটা পাড়া থাকে কি? কিংবা একটা জায়গা, নেশার-মোহের-ভরসার-অভ্যেসের। অঙ্কুর সূর্যাস্তের পর এল সেদিন। আর দু’হাতে মেখে-মেখে দিতে থাকলো সমস্ত চাওয়াগুলোকে, হাতে-গালে-কপালে! অঙ্কুর চাইছে, খুব করে চাইছে – একটা সোনামাছ! যেন ভ্রান্তিবিলাস জমা রেখে রেখে নিজেদের অপরাহ্ণের কাছে বেচে দেবার পালা। অঙ্কুর আর আমি, আমি আর অঙ্কুর – উড়ে বেড়ানো, ঘুরে বেড়ানো, ডানা মেলার খেলা।
তবে পিছ্লে গেলাম বটে! ‘ভুলে যাও, প্লিজ ভুলে যাও’ উড়ে এসে ঠিক ঠিক জুড়ে বসলো আমাদেরও মাঝে। অঙ্কুর খুব করে আমার স্মৃতিবিভ্রম চাইছে আজ। ভুলে যাও অপমান – অসম্মান – নিকৃষ্ট গালিগালাজের দিন, ভুলে যাও শরীরের ক্ষতচিহ্ন যত!
অঙ্কুর আমার ভেতরটা মাড়িয়ে আশ্চর্য এক দম্ভে বাঁচে ইদানীং। এবং আমি কেবলই কৈশোরে ফিরে যাই।

চারঃ
গোধূলি পেরোনো নৈঃশব্দ আঁকড়ে ধরলে ভাবতে শেখার পালা – মা-ও এভাবে ভুলে যেতে যেতেই জড়িয়ে গিয়েছিল বুঝি! ভুলে যেতে যেতেই মায়ের মাঝে আমরা বসত বাঁধি, মায়ের এক জন্মের কী তীব্র আফসোস। পালাবার দ্বারের শেষ কপাট তুলি - এই আমরা!

পাঁচঃ
আজ এতকাল পর তরুণী-সন্ধ্যায় অঙ্কুরের চোখ দুটো কী ভীষণ চেনা-চেনা এক ভয় এনে দেয় ফের! ঠিক যেন রোদ-রোদ বিষণ্ন কার্তিকের দুপুরে অস্তিত্বে ভাঙন। ঠিক যেন অসহ্য সেই ডুকরে ওঠা! অনেক দিনের ধুলো মুছে চেনা বিষের কী অদ্ভুত অনুভব।
দিনশেষে আবার আমার মিতালীকে মনে পড়ে, মা-কে মনে পড়ে খুব আর মনে হতে থাকে –
‘অতো ডরাইবার কি তা আছে? সব মানুষ আর তুই কি তা এ্যাক নি?’……
তখন নিষ্পলকে দেখি ঘরের কোণে এ্যাকুরিয়ামে গোল্ড-ফিশটা ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় ঘুরপাক খায় কেবল।

মন্তব্যসমূহ

কবিদের গদ্য বরাবরই এরকম ঈর্ষণীয়। দারুণ লাগলো। :-)
ভালো লাগলো রে!
বিশ্বাস থাকুক তবুও...
ভালো লাগা ভালো লাগার ... :)
কী যেন ভাইয়া ... ভালো থাকিস তুই...

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]