'নিলীয়মান' শব্দের ঘোর ...


মন খারাপের বিষয়গুলো অদ্ভুত। মাঝে মাঝে অযথাই কিংবা মাঝে মাঝে কারনটা ঠিক কোনটা খুঁজে বের করা যায় না। অনেকদিন ‘কি রে সকালে ফোন দিলিনা, মন খারাপ?’- শোনা হয়নি বলেই কী মন খারাপ হয়ে থাকে? না কী যা পাইনি তা নিয়ে ভাবছিই না আসলে, যা আছে তাও যে নেই তাই মনে মনে মন ‘মন’-কে বলে! ‘বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয়, তার নাম নিঃসঙ্গতা।’- এরকম একটা কথা লেখা থাকে ভাস্কর-এর ‘শয়নযান’-এ।

আর ‘নিলীয়মান’ কথাটাও এ বইটাই আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বিলীন হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে ট্রাজেডি থাকে তাও। হঠাৎ করে নেই হয়ে যাওয়া, বুক সেলফ ছেড়ে, একটা পরিচিত জানালা, বারান্দা, ঘর, চেনা মানুষ, অচেনা পথ, পছন্দ-অপছন্দগুলো ছেড়ে। এমন নেই-গুলোও একসময় আসলে কোন শূন্যতা ধরে রাখে না। এটুকু ভাবতে কষ্ট হয় বলেই আমরা ভাবিনা হয়তো বা। আসলেই কি শূন্যতা থাকে? শূন্যতা থাকে না বলেই কি বেঁচে থাকার একটা অজুহাত খুঁজে পায় না মানুষ? একটা অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার পরে কোথাও যে কিছুই থেমে যায় না এটাই বেশ অদ্ভুত এক ব্যাপার। সেই বিবেচনায় ব্রক্ষ্মান্ডও ভীষণ স্বার্থপর বটে!

একটা জীবনে কত কী ঘটতে পারে তা জীবন এসে এসে দেখিয়ে দিয়ে যায় আমাদের। আর মাঝে মাঝে কী দারুণ চমকেও উঠি বটে! একসময় যে মুহূর্তকে যন্ত্রণার চরম সময় মনে হতে থাকে তাও তো শেষ হয় কোন এক প্রান্তে এসে। দুর্দান্ত কোন ভালোলাগার অপর পিঠেও কত অপ্রাপ্তি সাজিয়ে রাখা থাকে। এসব টঙ চায়ের দোকানে বসে বসে ভাবা হয়েছে আমার অনেক। এলোমেলো ভাবতে তবু বরাবর আমার ভালো লেগেছে। আর এইসব দিনে বেশ লাগে কবিতা পড়তে, কিংবা এরকম কোন কোন গদ্য, উপন্যাস আর গল্পের টুকরো টুকরো অংশ যা আগে থেকেই পড়া, যা জানা আর জানি যে গলার কাছে আটকে যাবে অক্ষরগুলো।

এই যেমন বিভাস রায়চৌধুরী পড়তে পড়তে পড়ছি যে –
“তার মানে এই নয় যে, গলা চিরে
মুখে রক্ত তুলে
বলতেই হবে – ভালবাসি …

কিচ্ছু না বলেও ভালবাসা যায়।

আমরা এতো মার খেয়েছি, ‘ভালবাসি’ও
বলতে পারি না …
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি শুধু।

আমরা বলতে ঘেঁটুফুল, হাঁড়িচাচা, ঝিনুকডোবা নদীর
কথাও বলছি।

আমরা চেঁচিয়ে ভালবাসার কথা বলি না।
চুপচাপ পাশাপাশি থাকি সারাজীবন।” – (সাঁকো, পরজন্মের জন্য স্বীকারোক্তি)
কিংবা
“দুঃখের দিন এলে দম বন্ধ হয়ে আসে।
খুবই কষ্ট হয়।
ভাবি, কবে দিনগুলো পার হয়ে যাব?” (নবীন, পরজন্মের জন্য স্বীকারোক্তি)

কী যে চাওয়ার থাকে তাই জানা থাকে না আমাদের। কী চাওয়ার থাকে? জ্বর জ্বর করলে কেউ আমার থেকেও বেশি অস্থির হয়ে খবরটুকু নিবে? একটা ফোন-কল খুব কান্না পাওয়া মুহূর্তে? কিংবা আমার মন খারাপে কারও একটু উদাস লাগবে আমায় ভেবে?
না কী একটা কোন নাটকে জড়িয়ে যাওয়া যে চরিত্র চরম কাঙ্খিত এমন কিছু পেয়ে যাওয়া হঠাৎই? একটা গল্প নয়তো কবিতা লিখে ফেলা? কিংবা বসে বসে দিনগুলো ‘স্রেফ কাটিয়ে দেওয়া’… ‘শয়নযান’ এ ভাস্কর যা করতেন বলে গেলেন তাই…
এলোমেলো ভাবনার মধ্যে তখন ভাবনা আসে কার কার সাথে বেশ কয়েক ঘন্টার মধ্যে কথা হল না। ভেবে দেখি অনেক আপন কিংবা মুখ-পরিচিত কারও সাথেই না… বিলীন শব্দটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য হয়ে গেলে একটা ব্যাপার খুব মজার হতে পারে, অনেক দূরের কোন শহরে খুব পরিচিত কারও কাছে হয়তো খবরটা আগে পৌঁছে যাবে এফবি-র কল্যাণে, আর এই শহরের কারও কাছে হয়তো সন্ধ্যা-রাতেরও পরে…
আমার হঠাৎ সন্দীপন-এর একটা লাইন মনে পড়ে … আমার কেবল এবং কেবলই এইসমস্ত কথা-বাক্য-শব্দেদের মনে পড়ে পড়ে গেল চলতি পথেই …
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এক লেখায় বেশ বলেছিলেন বটে –
“..কেননা, আমি দেখলাম মৃতের গল্প কোনো জীবিত মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। তা যদি হত, তাহলে জীবিতের ত্বক মৃতের চামড়া গ্রহণ করত। কিন্তু, না, জীবিতের শোক মৃত গ্রহণ করে না।”


মন্তব্যসমূহ

Tahzib বলেছেন…
“তার মানে এই নয় যে, গলা চিরে
মুখে রক্ত তুলে
বলতেই হবে – ভালবাসি …

কিচ্ছু না বলেও ভালবাসা যায়।

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]