কফিনের সংসার

দুটো কফিনের বাক্স কয়েকটা সংসার এর সরঞ্জামাদিতে ভরপুর। কফিন দুটোতে যারা এসেছিল তাদের অস্থি-মজ্জা এতোদিনে গোরস্থানের মাটি কিছুটা উর্বর করেছে। মৃতজীবী, ক্ষুধার্ত পোকা-মাকড়ের অন্ন যুগিয়েছে ওদের দেহ। শুধু কফিন দুটো বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে শুকিয়ে বহাল তবিয়তে ঠায় দাঁড়িয়ে ফুটপাতের অর্ধেক জায়গাজুড়ে।

অনায়াসে মৃত শরীরের বাহনের ভেতর জীয়ন্ত মানুষগুলোর যাবতীয় সংসারের ঠাঁই মিলেছে। ফুটপাতে গজিয়ে ওঠা ভরন্ত সংসার। একটা-দুটো নয়, চার-পাঁচ ঘর সংসার ঢুকে গেছে দুটো কফিনের ভেতর। ভরপুর সংসারের উপজীব্য কাঠের কফিন। একটার উপর আরেকটি তুলে রাখা, একটুখানি ফাঁক ডানপাশে। উপরেরটি থেকে সময়মত বের করা হয় হাড়ি-পাতিল-গ্লাস। নীচেরটায় বিছানা-বালিশ, কাপড়-চোপড়।
আসমা ইট আর লাকড়ির চুলো সাজায়। চুলো সাজায় রুকি, ডালিয়া, মইন্যার মাও। পথচারীর পথ আর থাকে কই। তবে অসুবিধা খুব একটা হয় না। গোরস্থানের দেয়াল লাগোয়া এই সংসারগুলোর সাথে বেশ ভাব দারোয়ান আর কর্তৃপক্ষের। প্রতি শুক্রবার কবর জিয়ারত, দোয়া, মিলাদ, দান-খয়রাত এর বদৌলতে মোটাসোটা আয় হয় এদের। শবেবরাত-শবেকদর-রমজান-ঈদ এর কথা বলাই বাহুল্য। দারোয়ান- গোর খোদক - ড্রাইভার- রক্ষণাবেক্ষণের কর্মী- ঝাড়ুদার - এদের ওদের সাথে ভাগ-বাটোয়ারা করে, দিয়ে-নিয়ে, লাভে-লোকসানে ভালো বৈ মন্দ নয় আয়-রোজগার।
আসমার দিন আমোদেই কাটে। কবে কোন্ আশ্বিনে মুখে স্তন গুঁজে মা এই শহরে নিয়ে এসেছিলো সে বৃত্তান্ত মার মুখেই শোনা। এ শহরের অলি - গলি, ঘুপচি আন্ধার আর ঝলসানো পথে তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এখন ষোড়শী কন্যার সংসারে একজন অন্ধ সঙ্গী আর কোলজুড়ে আটখানা ছা। অন্ধকে সবাই বুড়া ডাকে। জন্মের পর বুড়ার নাম কি ছিল, কিংবা আদৌ কোন নাম মা-বাবার কাছ থেকে বুড়া পেয়েছিল কিনা তা আসমারও জানা নেই। তিনজন ঘরণীকে কোন্ কোন্ পথের বাঁকে যেন রেখে এসে এখন এই আসমার সাথে ঘর করছে বুড়া। দিন-রাত্রি লাঠি ধরে পথে বসে দু’এক পয়সা কামাই করে, বলা চলে আসমার ঘাড়ে চেপেই পথ চলে। আসমা টাকা আনে কিংবা কোন না কোনভাবে খাবার যোগাড় করে। ষোড়শীর শরীরে ছল ছল নারীত্ব, বুড়া অনেককিছুই জেনেও দেখে না বটে। অন্ধত্ব তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

মইন্যার মা’র কষ্টের দিন শুধু ঘুচে না। মা-বেটা দু’টা মাত্র মানুষ, হোটেলের উচ্ছিষ্টে ভরপেট খেয়েও বলে ফিরে - “আহারে! মোর জমিন, উডান, ঘর সব তলায়া গ্যালো। হায়রে রাক্ষুইসী নদী। কই পামু এমুন ঘর-গেরস্থালী। আফনে কই গ্যালেন মইন্যার বাপ।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডুকরে কেঁদে উঠলে পাঁচ বছরের মইন কোন এক অজানা ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।
খানিক দূরে সবজির ঠেলা নিয়ে বসে থাকে শামসু আর চায়ের অস্থায়ী টঙটাকে প্রায় স্থায়ী করে ক’দিন থেকে চা-বিস্কুট-কলা-সিগারেট-পান নিয়ে পসরা সাজিয়েছে গণেশ। বিদ্যুতের খুঁটি দুটোয় রশি বেঁধে কিংবা কবরস্থানের গ্রিলে বেশ শুকোচ্ছে ওদের ভেজা শাড়ি, ব্লাউজ, বাচ্চার কাঁথা, প্যান্ট, টুকরো ত্যানা। ফুটপাথের ধারে এসে মিলেমিশে একাকার ঘর- গেরস্থালী- রাজপথের চাঞ্চল্য কিংবা দিনযাপন।
মৃত্যুর শীতলতা চোখে- মুখে মেখে আল-আমিন গোলাপজল-কাফনের কাপড়-আগরবাতি সাজানো ‘শেষ বিদায়’ স্টলে বসে থাকে। বারোমাস সাদা টুপি মাথায় হাসি-কান্নার নিপুণ অভিনয় করে চলে।
বাচ্চাগুলো খেলে বেড়ায় - হেসে কাটায় অহর্নিশ দিন-রাত্রিগুলো। কত কত কাফনমোড়া লাশ আসে নিত্য, কয়েক মুহূর্ত পর পরই। খেলা ফেলে দৌঁড়ে যায় পাঁচ বছরের মইন, দশ বছরের মিতালী, আট বছরের শ্যামা, রুকসানা, চৌদ্দ বছরের কলিম আরও গুটিকতক পাঁচ-তিন-নয়-দশ-বারো-চৌদ্দ বোঝাই দল। তিন বছরের আয়শাটাও ইদানীং এগোয় গুটি গুটি পায়ে। বড়রাও এগোয় তারপর ধীরে ধীরে। মৃত্যু এখানে উৎসব, মৃত্যু এখানে পাঁচ-দশ-বিশ-পঞ্চাশ টাকা পেয়ে চকোলেট-চুইংগাম-ঝালমুড়ি-লজেন্স কিনে খাওয়া। মৃত্যু এখানে জীবনধারণের অন্যতম পন্থা।
আঞ্জুমান মুফিদুলের লাশবোঝাই গাড়ি মানেই তাই চরম বিরক্তি। বেওয়ারিশের দোয়ায় কেউ অর্থ ঢালেনা। বেওয়ারিশ লাশের ভাগ্যে ভ্রু-কুটি ছাড়া কিছুই জোটেনা।

এভাবে দিন কেটে যাওয়ার কথা। এভাবেই দিন কেটে যাবে। তাই এর বেশি কিছু ভাবতে পারেনা মানুষগুলো কিংবা ভাবনাকে অন্য কোথাও ঠাঁই দেয়ার ইচ্ছাই নেই ওদের। আসমা তাই রুটি-তরকারি মেলে ধরে আটটা আন্ডা-বাচ্চাসহ সকালের নাস্তা খেতে বসে পড়ে। বুড়ো হোটেলের দয়ায় চা খেয়ে বিড়ি ধার করে গণেশের কাছে। রুকিকে আজকাল আল-আমিনের সাথে কোথায় কোথায় যেন উধাও হতে দেখা যায় সন্ধ্যার আঁধারে। শামসু মাঝে মাঝে মইন্যার মাকে নিজ থেকেই দিয়ে যায় কপিটা, বেগুনটা, শাকের গুচ্ছাটাও। আর গণেশ জমানো টাকা থেকে এক হাজারে একটা মোবাইল কিনে নিল কয়েক বছর পুরোনো এক সাধ মেটাতে।

নিত্যদিনের মতো সূর্য-চাঁদের আলো-আঁধারি খেলার পরে রাত নেমে আসে। কবরের উপরে আলো ছড়ায় সরকারী বাতিগুলো। কফিনের পাশে সারি সারি পলিথিন-তাবুর আড়ালে যাযাবর সংসারগুলো দিব্যি সুখনিদ্রায় ঢলে পড়ে। কিন্তু হঠাৎই প্রচন্ড হট্টগোলে চমকে ওঠে রাত। বুড়ার কর্কশ আর্তনাদে কোন এক শিশু ঘুমভাঙা কন্ঠে কেঁদে ওঠে। বুড়ার মাথা ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে অন্ধ দু’চোখ বেয়ে। আকুলভাবে তবু কয়েকটা টাকা জড়িয়ে আছে বুড়া। কফিন দুটো উল্টে পড়ে আছে বেওয়ারিশ হয়ে। চার-পাঁচটি সংসার এখানে-ওখানে ছড়িয়ে লন্ড-ভন্ড হয়ে গড়াগড়ি খায় রাস্তায়। লাঠির নির্যাতনে পলিথিনের সম্ভ্রম খুলে নগ্ন হয় সাংসারিক নিদ্রা। ফুটপাত-দখলমুক্তকরণ কমিটির কর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এ রাস্তা- সে রাস্তা, এ ফুটপাত-সে ফুটপাত ঘুরে ঘুরে রাতশেষে এখানে পৌঁছে।
সিটি-কর্পোরেশনের গাড়ি বোঝাই হয়ে অনেক জিনিস অদৃশ্য হয়ে যায়। ততক্ষণে মাটির হাড়ি-পাতিল ভেঙে চৌচির, ভয়ার্ত শিশুদের ক্রন্দন শ্রান্ত ফোঁপানীতে সীমাবদ্ধ। আর বুড়ার মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে মানুষ আজকাল বড্ড বেশি বাতাস টেনে নিচ্ছে নি:শ্বাসের সাথে। বাতাসের অনেক অভাব বোধ হয় পৃথিবীতে.....

সকালের আলো ফুটলে কফিনের বাক্স দুটোকে কোথাও দেখা যায়না। শুধু বুড়ার লাশটার জন্য কাফনের কাপড় ফ্রিতে দিয়ে দেয় আল-আমিন। একেবারে ছোটটিকে নিয়ে আসমা সেই সাত-সকাল থেকে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। সাতটি ওয়ারিশ নাকের সর্দি - চোখের জল মিশিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেও বুড়ার লাশ দাফনে কেউ অর্থ ঢালেনা। তাই বেওয়ারিশের সমতুল্য দোয়া-দুরূদটুকুই জোটে লাশের ফেটে যাওয়া কপালে।

মন্তব্যসমূহ

কী বোর্ড ফেলে দিসনি দেখছি। হৃদয়টাও আছে দেখে ভালো লাগছে।
@সঙ্গীত দা,
অনেক দিন আমি ব্লগস্পটে আসতে পারিনি ভাইয়া...
নেট প্রোব্লেম করছিলো...
ভালো লাগছে আজ এসে তোর মন্তব্য দেখে...
ধন্যবাদ :)

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]