মৃত প্রহরের যন্ত্রণা মেপে চলা কিংবা ছুঁয়ে দেখা ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়স্কোপ

সম্পূর্ণ তরতাজা একটা শহরকে মৃত মনে হচ্ছে ইদানীং। রগরগে বিক্ষিপ্ততায় বিকেল ভেসে যাচ্ছে যখন – শূন্য-অসাড়-হাহাকারময় আমিত্ব নিয়ে ‘আমি’গুলো সব ছিন্নভিন্ন, ঝাঝরাও।

তবু ভুল হাসি পরে পরে হেঁটেছি নাগরিক পথে। ভাগ্যিস কেউ চোখে চোখ রাখেনি। আর্তচিৎকার থমকে দাঁড়ায় কোলাহলের ভয়ে, এ শুধু ঘরে ফেরার পরাজিত পদক্ষেপ জানে। অস্তিত্বের আনাচে-কানাচে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় এক। আমি তবু ফিরে ফিরে ধ্বংসকালীন বোবা গল্প পড়ি –
“গদ্যের মধ্যে কবিতার পঙক্তি ভরে দিয়ে বসে থাকি। কবে আর আসে এমন ভাষা, এমন নিবিড় প্রেমে! ভালোবাসা ততক্ষন ভালোবাসাই নয় যদি না তার জন্যে হাহাকার উঠে তোমার ভেতরের গভীর খাঁজে। যদি না তুমি কাঁদতে বসে যাও তার জন্য।” (ধ্বংসকালীন বোবা গল্প)


কেমন করে বাজাতে জানেন গল্পওয়ালা, গহীনে কোথায় যেন বিঁধলো বটে! জ্বালা-ধরা চোখ তো ভীষণ ক্লান্তও, কোন্ অজুহাতে আর উগরে দেওয়া যায় অভিমানের এক সহস্র ঢল।
রমাপদ-এর ভুবন ভোলানো বাঁশিই কি তবে অনেকখানি নয় রমনীর রাত-জাগা নিশি-লাগা মগ্ন মুহূর্তে?
“আর রমাপদ?...সর্বস্ব হারানো, মার খাওয়া মানুষের মতো বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে পালাচ্ছে, দোহাই, তুই, বাবা রজু আমার, তুই দেখতে চাস না কী আছে লুকানো... এই আমার শেষ রহস্য জন্ম ও জীবনের।” (ব্যতিহার)

ভাবতে ভাবতে পড়তে পড়তে প্রহরের পরতে-পরতে মিশে যায় ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়স্কোপ
(সুমন সুপান্থ-এর গল্পগ্রন্থ, প্রচ্ছদঃ শিবু কুমার শীল, প্রকাশকঃ ভাষাচিত্র, প্রকাশকালঃ অমর একুশে বইমেলা ২০১২)। যেমন করে বলেছেন গল্প বলে চলা, লিখে চলা মানুষটি নিজের কথা নিজের ভাষায়-
“আমি লিখতে চাই গল্প। আর কবিতা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।” (সুমন সুপান্থ)

ঠিক তেমন কথাই ভেসে ভেসে ওঠে তুচ্ছ এ পাঠক-মনে। লিখতে চাওয়া লিখে-রাখা সেসব গল্পেরা-কথারা হামলে পড়ে অস্থির মুহূর্তজুড়ে।
“স্মৃতিশিহরিত মেয়েটা কান্না মুছে দেখলো আকাশে শেষবেলার খেলা। কোথাও কো্নো মেঘ নেই। ভ্রম। তার নিজের মনের সাপলুডু খেলা। পাখিরা তখন ডানায় রং নিয়ে বাড়ি ফিরছে। আর রিপন ছেলেটা তার হাতে গুঁজে দিচ্ছে একটা সবুজাভ পালক। মনে মনে সে রিপনের পালক ধরা হাতে চুমু খেলো। পৃথিবী পৃথিবীকে ঠিক এমনটাই দেখতে চায়। জীবন জীবনকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় সবখানে। মানুষ একদিন এইসব জানতো। ”(ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়স্কোপ)

সত্যি আজও যদি জানতো মানুষ কিংবা মানুষেরা প্রত্যেকেই, ভ্রম-বিভ্রম কাটিয়ে উঠার খেলায় তবে কী জিতে যাওয়া যেত প্রতিবার। কী করে জানা যাবে আর! প্রতিটা দগ্ধ অনুভবই কি প্রশ্নবিদ্ধ নয় কিংবা অমীমাংসিতই শেষমেশ?
“সবার গল্প যেমন আলাদা, মীমাংসার ধরণও কি তাই নয় ? মানুষ জন্মের রহস্য বোধ করি এই, প্রত্যেকের জন্মযাতনা আলাদা…”(ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়স্কোপ)

কখনও কখনও কি ভয়ঙ্কর এক বোধ গলার কাছে কামড় বসায় না? যেন এই সেই বোধ, গল্পওয়ালা আরও একবার দুমড়ে মুচড়ে দিলেন ভেতরকে –
“বড় হওয়া অনেক কষ্টের। বড় হলে কেবল মরে যেতে ইচ্ছে করে। শৈশবে যে জীবনকে ঘুড়ির মতো পলকা মনে হয়, বড় হলে তাকেই বোঝার মতো লাগে। সবার কি এমন হয় ?” (ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়স্কোপ)
এমন করে কবে আর ভাবতে শেখা হল! ভুলে-ভর্তি শূন্য জীবন যেন আর্তনাদ করে ওঠে।

মাঠ-ঘাট-বন-জঙ্গল পেরিয়ে এক সহজ সরল মায়ের ততোধিক সারল্য-ভরা ছেলেটার রাজনীতির জালে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায়, মৃত্যুময় বিষাদে ভেঙে ভেঙে পড়ে মন।
“গলার ভেতর প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে সে মাকে ডাকতে চাইলো আবার -‘আম্মা, এরা আমারে মারি লাইলো। তুমি আমারে বাঁচাও আম্মা...আ-ম্মা...আমি মরি যাইরাম...’ । এবারও কথাগুলো বেরিয়ে আসতে পারলো না। মাথার পেছন দিকে আরেকটা সীসাখণ্ড ঢুকে মগজের অন্দরে এমন ছোবল মারলো সে দিগ্বিদিকশূন্য, জ্ঞানহীন শেষবারের মতো ছুটে পালাতে চাইলো। কিন্তু ছুটে গিয়ে পড়লো খালের পানিতে। তাতে কোন পরিত্রাণ নয়, তার তৃষ্ণাই বেড়ে গেল কেবল। কুকুরের মতো চুকচুক করে পানি খেতে চাইলে, খালের পানিতে ভাসতে থাকা চাঁদ, গরম রক্তের সাথে মিশে তার মুখগহ্বর গলা অব্দি তেতো করে দিলো। এবং, সম্ভবত জীবনে শেষবারের মতো আবার তার আলতো অভিমান হলো মা’র ওপর - ‘আম্মা, আমি হাছাই মরি যাইরাম। তুমি অখনও আইলায় না...!” (হননপিয়াসী রাত)
এতো সহজ মৃত্যু! এতো সরল তার আগমনের পথটুকু! আমার আবার কেবলই গল্প-কথা মনে পড়ে যায়-“মৃত্যুর গল্পে দীর্ঘ মিছিল।” (ধ্বংসকালীন বোবা গল্প)

অতঃপর ভাবনারা-শব্দেরা-উপলব্ধির অনুভবেরা জড়িয়ে জড়িয়ে যায় সমগ্র সত্তায়। ক্ষুদ্র আমি ততোধিক মূর্খতা নিয়ে ভেতরে বয়ে চলা প্রচণ্ড ভাবাবেগ উগরে দিতে চাই কেবল। লিখতে-লিখতে বকতে-বকতে অহেতুক ছাই-ভষ্মে ভরে যায় একের পর এক সাদা পাতা। প্রতিক্রিয়া কিংবা অভিব্যক্তিটুকুও যেন ধরা দিল না, জীবনের সকল ব্যর্থতা উঁকি-ঝুকি দিয়ে গেলে বোঝা হল একটা কিছু লেখার ছলে আরও কয়েক পাতা ব্যর্থ প্রচেষ্টা জমে গেল চলতি পথে। তবু ঘুরে ফিরে ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়স্কোপ-এর পাতা ছুঁয়ে দেখা বারকয়েক, আবার পড়া-
“মৃত্যু বড় মুর্খ, তারে জন্ম দিতে দিতে জীবনের বৃদ্ধি পায় দেনা।” (উৎসর্গ পাতায় লেখা জনৈক কবির কবিতা)

আর হ্যাঁ, এমন করে এইভাবে জানা হয় – কোন কোন বইয়ের পাতায় দেখো খুঁজে পাবে তুমি, তোমার আর্তনাদ, তোমার গুমরে ওঠা, তোমার দীর্ঘশ্বাসের সমূহ কারণ কিংবা তোমার গহীনে লুকোনো আততায়ী কান্নার ঢল।

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]