ক্ষণিকের আয়োজন

শ্যাওলাপাড়া থেকে মানুষের নিঃশ্বাসে গরম হয়ে উঠা বাসের অস্বস্তি গায়ে মেখে সায়েন্সল্যাব. এসে পৌঁছায় আদিব। তবু সকালের দিকে বাসের ভেতরের অবস্থা সহ্যসীমার মধ্যে থাকে। সন্ধ্যায় অফিস ছুটির সময় ক্লান্ত - শ্রান্ত বাঙালির ঘামের নোনা গন্ধে, টিকেট কিংবা ছোটখাট বিষয়ে কনটাক্টারের সাথে যাত্রীর তুমুল বাগবিতন্ডায়, অকথ্য গালিগালাজের উচ্চারণে অস্বস্তি সহ্যসীমা পেরোয়। টাইয়ের নব ঠিক করে নিয়ে ধানমন্ডির ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে আদিব। আজ অতোটা দেরী হয়নি, হেঁটেই পৌঁছে যাবে অফিসে। আভিজাত এলাকার ফুরফুরে বাতাসের মাঝে হাঁটতে ভালই লাগে।

অফিসের থাই গ্লাসের দরজা খোলে দেয় ডোরম্যান। ‘গুড মর্নিং স্যার’- সাদর সম্ভাষণের সাথে লোকটির মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলে থাকে। বাংলাদেশের শহরগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা মাল্টিন্যাশনাল অথবা দেশীয় প্রাইভেট কোম্পানীগুলোতে আভিজাত্য প্রকাশ ব্যবসারই অংশ। স্মরণ আহসান আদিব - সেলস্ এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার। কিন্তু মাঝে মাঝে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবধরনের কাজই করতে হয় বসের আদেশে। ছোটখাট কোম্পানীগুলোর এই এক বিরাট সমস্যা। জনবল বাড়াতে পারেনা। অথচ সাফল্য চাই ষোলআনা। করারই বা কী আছে, টাকার অংকের কাছে বাড়তি কষ্ট অগ্রাহ্যকর। ডেস্কে বসে কম্পিউটার অন করে আদিব। এবার টানা নয় ঘন্টা এ যন্ত্রই সঙ্গী হবে। মাঝে আধঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকে একটু রেহাই পাওয়া। ফাইল ওপেনের অপশনে প্রেস করার মুহূর্তে সেলফোনে মেসেজ টোন বাজে। ওপেন করতেই কেয়ার অভিমানভরা বাক্য কিছুটা বিষন্ন করে দেয় - ‘‘Suprovat :) Ke tedy bear? Khub busy? Sokaler surute ekbaro mone podlona amy?”

আজ বিকেল ওর সাথেই কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু অফিসে জরুরী মিটিং , সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে অফিসেই। চিন্‌চিনে ব্যথায় বুক ভরে যায়। একটা কল করার চেষ্টাও ব্যর্থ হল। বস্ রুমে কল করেছেন, যেতে হবে এক্ষুনি।
বসের রুমে থমথমে অবস্থা। যাদের উপর মিটিংয়ের কোন না কোন ডিউটি আছে সবাই উপস্থিত। তারপর শুরু হল পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, কে কতটা করেছে, কার কাজে ফাঁক রয়ে গেছে। সবশেষে বেরিয়ে আসার অনুমতি পেয়ে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। চেয়ারে বসে আজকের প্রেজেনটেশন আরেকবার দেখে আদিব। হঠাৎ সৌম্যর কথা মনে পড়ে। কালকে বাসায় এসেছিল। এখনও একটা চাকরি জুটাতে পারেনি। আদিব পরিচিত অনেককে বলে রেখেছে, ঐ কোম্পানীগুলোতে পোস্ট খালি হলে খবর পাবে। একফাঁকে পাশের ডেস্কের আদনান ভাইকে বলে রাখে। আজকাল জ্যাক ছাড়া কিছু হয়না। আদিবও তো কম ঘুরেনি একটা চাকরির জন্য। নিজেকে প্রমাণ করতে না পারার কষ্টের চেয়ে বড় কষ্ট আর হয়না। অথচ আজও কি পেরেছে নিজেকে প্রমাণ করতে? এই চাকরির জন্য শখের ফটোগ্রাফি প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। পথেই ছবির বিষয় খুঁজে ফিরতো আদিব। আজকাল আর সে সময় কোথায়? কত দারুণ সব সাবজেক্ট চোখে পড়ে কিন্তু লেন্সে বন্দি করা হয়না ওদের। একদিন ছিল যখন এক্সিভিশন করার জন্য দুহাজার টাকা ছিলনা হাতের মুঠোয়। আর এখন, টাকা আছে কিন্তু সময় নেই প্রস্তুতি নেওয়ার। তবুতো অনেক কষ্টে থিয়েটারটা চালিয়ে যাচ্ছে এখনও।

কেয়াকেও ক্যামেরার ফোকাসেই প্রথম দেখেছিল। আজও মনে পড়ে। কাজলের পুরু বোর্ডার দেয়া চোখের পাতা মোহাবিষ্ট করলো তাকে। কী দারুণ অভিব্যক্তি ফোটে ছিল চোখ দুটোয়। আর শাটারে বন্দি হল শ্যামরঙা অবয়ব। আর্টিফিশিয়াল লুক এড়াতে কখনও কখনও সাবজেক্টকে ফাঁকি দিয়ে ছবি তুলতে হয়। কিন্তু সেদিন ধরা পড়ে গিয়েছিল আদিব।
‘ভাইয়া, ছবি তুললেন?’ - কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও স্মিত হাসির আভা স্বাভাবিকতা এনেছিল আদিবের কন্ঠে - জ্বী।
- কোন পত্রিকার ফটোগ্রাফার আপনি ?
- কোন পত্রিকার নয়। শখের ফটোগ্রাফার।
- ও.....।

বইমেলা সেদিন তারুণ্যের রঙে রেঙেছিলো। বাসন্তী রঙের শাড়ি, হাতে গাঁদা ফুলের মালা জড়িয়ে কেয়াও সেদিন ফাগুনকে স্বাগতম জানাতে ব্যস্ত ছিল। সেই প্রথম। তারপর কি করে যেন ধীরে ধীরে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলো দুজনে। কেয়া তখনও ছিল ; যখন উৎফুল্লতা ছেয়ে থাকা ছায়াবিথীতলে জীবন তীব্র সুন্দর। তখনও ছিল সেই একইরকম ; যখন বিষন্নতা, অবসাদ, ব্যর্থতা নিয়ে জীবন বিভীষিকা। আজও আছে ; যখন জীবন কিছুটা সান্ত্বণায়, অনেকগুলো স্বপ্নের রঙে রাঙানো। কৈশোরের উচ্ছ্বলতা ঘিরে থাকে কেয়াকে আর অসহনীয় যন্ত্রণায় আদিবের দিন ঘোলাটে হয়ে গেলে সেই মুখখানি চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনে জীবনে।
‘ উফ! কোথায় ভাবলাম অফিস শেষে একটু ঘুরতে যাবো। তারও উপায় নেই। যেন কোম্পানী আমাদের কিনে নিয়েছে। সব ফ্রেন্ডরা যাবে পয়লা ফাগুনের অনুষ্ঠানে, শুধু আমিই থাকবনা।’ - পাশের ডেস্ক থেকে আফসানা আপুর অসন্তুষ্ট কন্ঠে ফিরে তাকায় আদিব।
- মাস শেষে একগাদা কড়কড়ে নোট জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হয়ে রইলো।
- সত্যি আদিব জানো, মনে হয়না একদিন সঙ্গীত বিভাগের ছাত্রী ছিলাম, রেওয়াজ করা হয়না বহুদিন।
টেলিফোনের রিং টোনে ছেদ পড়ে কথায়। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে যান্ত্রিক আন্তরিকতা ছলকে ওঠে আফসানার কন্ঠস্বরে।
যান্ত্রিকতা, যান্ত্রিকতা, যান্ত্রিকতা। নিজেদের ন্যায্য প্রাপ্য ভেবে দিনভর রস নিংড়ে নেয় কোম্পানীর রুলস্-রেগুলেশনস্। অবশেষে শেষ হয় প্রেজেনটেশন। টাইয়ের নব ঢিলে করতে করতে কিংবা ভ্যানিটি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে নীলাভ কাচঘেরা ভবন থেকে বেরিয়ে আসে একদল তরুণ - তরুণী। সবাই স্মার্ট, ওয়েল-ড্রেসড্ , শুধু দিনশেষে তারুণ্যের সজীবতা ফিকে হয়ে গেছে অনেকখানি।

আজকে অতিরিক্ত প্রেসার ছিল প্রতিক্ষণে, বাসের কথা ভাবতে প্রচন্ড অস্বস্তিতে মাথা ঝিমঝিম করে আদিবের। হঠাৎ সেলফোনের স্ক্রীনে ‘ঝুনঝুনি’ লেখা ওঠে। কেয়ার ফোন এসেছে।
- কি খবর ঝুনঝুনি? আজ এতো তাড়াতাড়ি রাগ পড়ে গেল যে?
- রাগ কমেনি। কিন্তু তুমি এখনও বের হওনি কেন অফিস থেকে?
‘এইতো মাত্র বের হলাম। কিন্তু কেন?’ - কিছুটা অবাক হয় আদিব।
‘ও হ্যাঁ, দেখেছি।’- এগিয়ে আসে কেয়া। অপ্রত্যাশিত এই মুহূর্তকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আদিবের।
- কি হল? হা করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো হাঁটি।
‘ এসময় বাসা থেকে বের হলে কি করে?’- হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে আদিব।
- আর বলনা। মামকে দিয়ে কল করালাম। মাম বললো আজ আমি ওর কোয়ার্টারে থাকবো। আম্মুতো কিছুতেই বের হতে দিবেনা। জিদ না করলেতো বের হওয়া অসম্ভব ছিল।

‘মাম’ কেয়ার ছোটখালামণি। কেয়ার জীবনে এমন কোন ঘটনা নেই যা মাম জানেনা। বলা চলে বিপদে কেয়ার একমাত্র ভরসা। ওপেন মাইন্ডেড, সিঙ্গল। সরকারী চাকরী পেয়ে একাই থাকেন কোয়ার্টারে। নিজের মতো করে জীবনকে এনজয় করেন - বেশ আছেন। কেয়া ছোটবেলা থেকেই মাম এর ভীষণ ভক্ত।
ঘন্টা হিসেবে রিকসা ভাড়া করে আদিব। সাধারনত ভাড়া ঘন্টায় পঞ্চাশ টাকার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে উৎসবের দিনে উৎসব মাফিক ঘন্টায় ভাড়া বাড়ে। কখনও কখনও আশি/ একশতেও পৌঁছে যায়। কিন্তু এখন বেলা পড়ে এসেছে তাই অতো দরকষাকষির ঝামেলায় পড়তে হয়না আদিবকে।

রিকসায় উঠেও অনবরত কথার ফুলঝুড়ি চালায় কেয়া। এই প্রাণবন্ত আলাপনের জন্যই ওকে ‘ঝুনঝুনি’ ডাকে আদিব। তবে আদিবকে ‘টেডি বিয়ার’ ডাকার পেছনে একটা ঘটনা আছে। একদিন নিউমার্কেটে ‘অকারণ ব্যস্ততার’ ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো দুজনে। সেদিন মাত্র আধঘন্টা সময় ছিল হাতে। দূরে কোথাও বসা যাবেনা। তাই বলে সময়টাতো হেলায় হারানো যায়না! মুহূর্তগুলো বন্দি করতে এটা ওটা দেখা, টুকরো টুকরো কথা বলা। হঠাৎ কেয়ার চোখে পড়ে সাদার মাঝে কমলার ছোপ দেয়া টেডিবিয়ার। সেদিন আদিবেরও পরণে ছিল কমলাÑসাদা ফতুয়া।
স্বভাবজাত উচ্ছ্বলতায় বলে কেয়া - অ্যাই দ্যাখো। ঠিক তোমার মতো দেখতে। গালটাও।
বলতে বলতে উচ্চস্বরে হেসেছিলো কেয়া। আদিবের গালদুটো যে ভরাট সেদিনই বাসায় গিয়ে বিশেষভাবে খেয়াল করেছিলো সে।
- আ্যাই, বল্লেনা আজ কেমন লাগছে আমায়? খুব সুন্দর, তাইনা?
হেসে ওঠে আদিব, আর কথার ঝুনঝুনি বাজতে থাকে বিরামহীন - জানো, মাম ডিশিসন চেঞ্চ করেছে। ঐ যে মাম এর সিনিয়র কলিগের কথা বলেছিলামনা। উনাকে মাম বিয়ে করে ফেলতে পারে।
- তাই নাকি?! তাহলে ‘ বিয়ে মানে চাল, ডাল, তেল, নুন। বিয়ে মানে স্বাধীনতার নাম-গন্ধ নেই। বিয়ে মানেই অযথা টেনশন।’ ইত্যাদি মতবাদ জলাঞ্জলি দিবে মাম। মুচকি হেসে চোখ কপালে তুলে আদিব।
- অসুবিধা নেই। মাম আগে থেকেই ক্লিয়ারলি কথা বলবে। ইউ নো, মাম বলেছে ‘নো কিডস্ কাপল্’ হবে। তাহলে অলওয়েজ ইয়ং লুক ধরে রাখতে পারবে।
- হুম্। সত্যি অসুবিধা নেই। আরও কিছুদিন ওয়েট কর, এ সিদ্ধান্তও চেঞ্জ হবে।
‘ তুমি মাম এর ডিশিসনকে ভুল ভাবছো?’- কেয়া কৃত্রিম রাগ দেখাতে চোখ ফেরাতেই আদিবের হাসির কাছে হার মানে।
‘তুমি না!’ - মৃদু অনুযোগে আদিবের হাতে হাত রেখে কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয় কেয়া। সাড়া দেয় আদিব। ফাগুনের টাটকা বাতাস ছুঁয়ে যায় দুজনকে।

অনেক অভিযোগ সময়ের কাছে, তবু এ প্রাপ্তিটুকুই বা কম কিসে? - আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে আদিব।

--------------------------------------------------

১৯/১১/২০০৮

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]