ক্ষেপাটে অস্তিত্ব কিংবা শ্যাওলার আস্তরণ

“কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নাহি, মহাগাথা গান গাহি
সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর।
কেহ যায়, কেহ আসে কেহ কাঁদে, কেহ হাসে,
খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশ পাথর ॥” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

sin, cos, ^/2, . . . . . . . .শ’খানেক ........ হাজারখানেক, না, না, লক্ষ কোটি ম্যাথম্যাটিক্যাল টার্মস মস্তিষ্কের কোষে কোষে তান্ডবনৃত্য শুরু করেছে। কি যেন করছে? হ্যাঁ, মনে পড়েছে, জটিল ইকোয়েশনের মধ্যে আছে সে। হাতের পাতায় আঁকিবুকির সংখ্যা বেড়েই চলে ক্রমাগত। খসখসে হাতে কালো কালো সমান্তরাল কিংবা এলোমেলো রেখা। সূর্যের তেজ খুব বেশি আজ। নোনতা ঘাম-ভেজা শরীর পথচারীদের। ক্ষেপার গায়ে চাপানো সেই কালো চাদর। বউ কবে যেন দিল, কাল বোধহয়, যখন কুয়াশা ছিল, নাকি ধোঁয়াটে সকাল আরও এক মাস আগে ছিল এই শহরে। ব্যক্তিত্বভাবখানা ছিটেফোঁটা থেকে গেছে ক্ষেপাটে অবয়বে।
আলুথালু লম্বা চুল, ময়লা পরিচ্ছদ - ক্ষেপাকে সহজে অবজ্ঞা করা যায়না তবু। মৃদু হাসির আভাস ছড়িয়ে সেলুন, দোকান, বাজারে; অলি-গলিতে ঘুরে ফিরে ক্ষেপা দিনমান ব্যস্ত থাকে। ধীরে ধীরে ক্ষেপা এক অভ্যস্ততায় পরিণত হয় তাদের কাছে, যাদের দৈনন্দিন চলাফেরা ঐ রাস্তাগুলোতে। অবাধ অধিকার ক্ষেপার সেলুনের চেয়ারে, দোকানের বারান্দায়, পরম প্রশান্তিময় শিশুসুলভ হাসিতে। ক্ষেপার পরিচয়ে ভরাট শ্যাওলার আস্তরণ, নাম-গোত্র-বর্ণের উর্ধ্বে ক্ষেপা শুধুমাত্র সুদৃঢ় এক ক্ষেপাটে অস্তিত্ব।

মহাকালের যাত্রাপথে ‘ক্ষেপা’রা অনায়াসে পথ চলে। ক্ষেপার চোখেমুখে তাই হাসির দমক - মঙ্গায়, সিডরে, ১/১১ এ, আইলায়, বিডিআর বিদ্রোহে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে. . . . . . . . . ক্ষেপা হেসে যায়। সূর্যেরা অত্যুজ্জ্বল দ্যুতির আশ্রয়, ক্ষেপার আকাশে লজ্জাবতী চাঁদেদের ঘর।
ক্ষেপা অচেনা, অজানা নাকি অনেকখানি চেনা? বিভ্রান্ত হওয়ার সময়টুকু ‘সময়’ এর অপব্যয় হতে পারে ভেবে কেউ আর একথা ভাবেনা। ক্ষেপার চারপাশে - কারও ভয়, কারও কারও এড়িয়ে চলা; তবু চকচকে দুটি চোখের তারা আমায় তা বলে না। কিছুটা বিস্ময় জাগে - উপহাস কেউ ক্ষেপাকে করে না কিংবা করতে পারে না।

চকচকে সাদা নতুন একটি শার্ট সেদিন ক্ষেপাকে খানিকটা বেশি লক্ষ্যনীয় করে তোলে। বিজ্ঞাপনের ‘এ এক নতুন সাদা’ রঙের শার্ট অদৃশ্যমান সনদপত্র যেন - ক্ষেপার এক ঘর আছে, গায়ে সাদা শার্ট চাপিয়ে দেবার কেউ আছে, ক্ষেপা পথ ভুলে কদাচিৎ সেই ঘরে ফিরে।

ক্ষেপা সময়ের ঘুড়িকে ভো-কাট্টা কেটে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। সময় বাস্তবতা নিয়ে ক্ষেপার সামনে আসেনা, কিংবা আসার সাহস পায়না। প্রাপ্তিকে দাবী ভেবে দিনের আঁধার, রাতের আলো নিয়ে ক্ষেপা আবেগী খেলায় মাতে। ছুট্ ছুট্ জীবন বয়ে বেড়ানো কলের মানুষগুলোকে সে অদ্ভুত চোখে দেখে।

ক্ষেপার অফিসফেরত অবকাশে এক কাপ চায়ের তৃষ্ণা নেই। খিটখিটে মেজাজে বউয়ের সাথে ঝগড়া করা নেই। সন্তানের মুখ ধরে চুমু খেতে খেতে তাকে নিয়ে সাজানো কোন স্বপ্নের ডালা নেই, তাই স্বপ্নভঙ্গ নেই।

ক্ষেপাকে নিয়ে সহানুভূতি দেখানো দুঃসাহসিকতা। ক্ষেপার হাসি ঘুণেধরা হতাশ চিত্তের পরম ঈর্ষা। ক্ষেপার অনাদিকালের গল্প তাই পূর্ণতার আস্বাদ পায়না।

------------------------------------------------------------------
[ পাদটীকা : যাকে দেখে এ গল্প লেখার অনুপ্রেরণা পেলাম গল্পটি তাকেই উৎসর্গ করলাম। ]

২৮/৫/২০০৯, রাত: ১.২০ ঘটিকা

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]