বেনীআসহকলা

সকালের স্নান সেরে ভেজা চুল আর ফোঁটা ফোঁটা জলের স্পর্শ নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো অর্চনা। স্নিগ্ধতা ফুটে ওঠে মায়াভরা মুখে। তবু ভাললাগার আমেজ নেই কোথাও। ব্যাকুল এই মন আজ আর কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। আলমারি খুলে হালকা কারুকাজ করা সাদা সুতির সেলোয়ার কামিজ তুলে নেয় হাতে। অভিমানভরা চোখে এক পলক দেখে নেয় আকাশী রঙের শাড়িটিকে। আজ এই প্রথম মন রাঙানো হলনা। সাদামাটা সকালকে তাই আরও বেশি বিষণ্ণ মনে হয়।

প্লাবন একটু আগেই ঝটপট নাস্তা সেরে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল অফিস করতে। ফিরতে বিকেল হবে। শুধু অর্চনারই অফিস ছুটির দিনগুলো এখনও ফুরিয়ে যায়নি। অল্প দিনের ছুটি নিলেই হতো-ভাবতে থাকে অর্চনা। অবশ্য তখন মনে হয়েছিলো -নতুন ঘর, নতুন মানুষজন, উপরন্তু জয়েন্ট ফ্যামিলি। এ্যাডজাস্টমেন্ট এ প্রোবলেম যেন না হয় তাই হঠাৎ একদিন ছুটি নেওয়া, হঠাৎ একদিন বউ সাজতে পার্লারে যাওয়া আর যেন হঠাৎ করেই একদিন এক অন্যরকম অনুভবে জড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে এ ঘরে চলে আসা। কেমন করে প্রায় দুটো সপ্তাহ কেটে গেল ভাবতে অবাক লাগে। বিয়ে, সংসার নিয়ে উদাসীন ছিল অর্চনা বরাবরই। ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিত সবসময়। তবু কৈশোরের অগোছালো কিংবা যৌবনের মোহাবিষ্ট ক্ষণে আনমনে স্বপ্নসুখে জড়ানো সুন্দর সংসার নিয়ে ভাবেনি তা নয়। আজ যখন সংসার হল, সত্যিকারের সংসার, মাঝে মাঝে ছেলেমানুষী ভাবনাগুলো মনে পড়লে হেসে ওঠে অর্চনা। তবে একটুকরো কৈশোর প্রতিটি মানুষই লালন করে মনের অজান্তে। হয়ত তাই অর্চনার মাঝেও বিয়ের পর দুরন্তপণা, আবেগী খেয়াল উধাও হয়ে যায়নি। এক অদ্ভুত খেলায় মেতে ছিল এতোদিন। মনে পড়ে খেলার নিয়ম তৈরী হয়েছিলো সেই সতেরো বছর বয়সের কোন এক বিকেলে। অর্কের সাথে তখন উড়ে উড়ে চলে এ মন। কলেজে তুমুল আড্ডা, বিকেলগুলোতে শুধু দুজন পার্কে কিংবা নির্জন রাস্তায়। প্রেম কিংবা ভালবাসা তখন এরই নাম। উদাস দুপুর বিষণ্ন বিকেল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অর্কই প্রথম বলেছিলো-তুই কিন্তু বিয়ের পর সাতরঙে সেজে থাকবি।
‘ সাতরঙে?’ - অর্চনা তাকিয়েছিলো অবাক চোখে।
- হ্যাঁ, সাতরঙে। বেনীআসহকলা, সপ্তাহের সাতটি দিন রঙধনুর সাতটি রঙে।

কোথায় সেই দুরন্ত কিশোর? বাবার হাতে ধরা পড়ে প্রেম হারিয়ে ফেলার দুঃখ ঊনিশেই ভুলে গিয়েছিলো অর্চনা। তরুণী অর্চনার সামনে ছিল শুধু কঠোর বাস্তবতা। অর্কের কথা ভেবে আর কষ্ট পায়না। তবু খেলাচ্ছলে দেখা স্বপ্ন হয়ত মনের কোথাও চুপটি করে বসে থাকে। তাইতো প্রথম সকালে বেগুনী রঙের জামদানী পরে প্লাবনের সামনে দাঁড়িয়েছিলো। প্লাবনকে ঠিক বুঝতে পারেনা সে। ছেলেটা গম্ভীর স্বভাবের। কথা খুব একটা বলেনা। অর্চনার মাঝে মাঝে মনে হয় কাজপাগল ছেলেটা কাজ ছাড়া কিছুই বোঝেনা। তাকে ভালভাবে কখনও দেখেছে কিনা সন্দেহ। আর বেনীআসহকলা সূত্র মেনে ওর শাড়ি পরার নিয়ম নিশ্চয় ধরতেই পারেনি। অর্চনাযে কথার ছলে ইশারা দেয়নি তা কিন্তু নয়। এইতো কদিন আগে বিকেলে যখন অফিসের ফাইলে মাথা গুঁজে ছিল, গাঢ় নীল শাড়ি, হাতভর্তি চুড়ি আর কপালের নীল টিপ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল অর্চনা টেবিলের পাশে।

- কাজের খুব চাপ বুঝি? সত্যি, অনুষ্ঠানের দিনগুলোর জন্য অনেক কাজ জমে গেছে। আমিও ভাবছি, অফিসে যাওয়ার পর সামলে উঠতে হিমশিম খেতে হবে।
খানিক নীরবতার পর মুখ প্লাবন। চশমার ফাঁকে অর্চনাকে দেখে ‘হুম’ বলে মাথা দোলায়, তারপর আবার ফাইলে। এতগুলো কথার উওর শুধুমাত্র ‘হুম’!! টিপ, শাড়ি, চুড়ি কিছু যেন দেখতেই পেলনা। অর্চনা ধীর পায়ে জানালার দিকে এগিয়ে যায়।
- বর্ষাকাল, অথচ বৃষ্টির দেখা নেই। জানো, বৃষ্টির পর রংধনু দেখতে অনেক ভাল্লাগে আমার। বেনীআসহকলা, রংধনুর সাতটি রঙ আর সপ্তাহেও সাতটি দিন। কী অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার, তাইনা?
ব্যাকুল শোনায় অর্চনার কন্ঠস্বর।
ব্যস্ততার ফাঁকে হাসিমুখে তাকায় প্লাবন - এক কাপ চা দিবে? মাথাটা খুব ধরেছে।
চমকে উঠে উওর দেয় অর্চনা - হ্যাঁ, দিচ্ছি।
ঘোর কাটলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে ম্লান হাসে, ভাবে-ভালো হয়েছে শোনার অবকাশ পায়নি। কী আবোল তাবোল বকছিলাম। নির্ঘাত পাগল ভাবতো আমায়।
কিন্তু অবোধ, অবাধ মন কে অভিমানী হওয়া থেকে বিরত রাখা যায় না। এই মন যেন স্থির, বাস্তববাদী অর্চনা থেকে যোজন যোজন দূরে থাকে। ভাবনায় আচ্ছন্ন অর্চনাকে হঠাৎ প্রমি জড়িয়ে ধরলে ভাবনার সুতো কেটে যায়।
- কি হল? চুপচাপ বসে ভাইয়ার কথা ভাবছো কেন? এসব ভাবনাকে একদম প্রশ্রয় দিবেনা কিন্তু। ব্যাস, একবার দিয়েছ কী মরেছ। আমাদের মা-কাকীমাদের দেখছ না? আজকালকার মেয়েদের শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। তোমার চারপাশে শুধু থাকবে তুমি, তুমি আর তুমি।
কথার রেলগাড়ি ছুটালে আর থামতেই চায়না। প্রমির স্বভাবই এমন।
খারাপ করা অনুভূতির রেশ কেটে যায় অনেকখানি।
হাসতে হাসতে বলে অর্চনা - নারী মুক্তি আন্দোলনে কোন দলের সাথে মাঠে নেমেছ শুনিতো?
- আহ হা ! ভাবী, নারীরা এখন সংঘবদ্ধ। আর মুক্ত তো আমরা হয়েই গেছি শুধু আবার যেন বদ্ধ না হয়ে পড়ি সেটাই দেখার বিষয়। এই সমাজটার তো কোন গ্যারান্টি নেই। কখন কী হয়ে যায়।
কথার মাঝে মুঠোফোন বাজলে প্রমি চঞ্চল হয়ে ফোন রিসিভ করে-
‘‘হ্যালো, আসছিতো।
- দেরী করছি মানে?
- দ্যাখো,চিৎকার করবেনা। রাতে কিন্তু ফোন ধরবো না বলে দিলাম।’’
ফোন রেখে অপরাধীর মতো হাসিমাখা মুখে বলে প্রমি - রাস্তায় এতো জ্যাম তবু কি করে যে এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায়?
চোখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে কথা বলে অর্চনা - সে কি? এতো ব্যাকুলতা থাকলে আন্দোলন চলবে কি করে?
- ব্যাকুলতা সে বুঝবে কি করে? গিল্টি ফিল করছি তাতো ওকে বুঝতেই দেয়নি।
- আই সী ! গ্রেট ট্যাকনিক।
- এখন উঠি ভাবী। ডোজ বেশী হলে প্রোবলেম হয়ে যাবে।
প্রমি বের হয়ে গেলে কৈশোর পেরোনো এই বেহিসেবী মগ্নতার কথা ভেবে মনে মনে হেসে নেয় অর্চনা। অলস দুপুর ক্লান্তি ছড়িয়ে দেয় শরীরে।

অর্চনার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন আকাশের নীলে সূর্য লাল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে দেখে প্লাবন বালিশে হেলান দিয়ে ল্যাপটপ এ গেইম খেলছে।
- চা খেয়েছ?
- না।
- দিচ্ছি।
অর্চনা ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথায় ওড়না টেনে নেয়। বাইরে অনেক মানুষ। যদিও এখানে সবাই ওপেন মাইন্ডেড। ভাল লাগে অর্চনার। যে ফ্যামিলিতে বড় হয়েছে সেখানে সংস্কার ছিল তবে আরোপিত অত্যধিক নিয়ম-নীতি ছিলনা। এখানেও তাই।
প্লাবন এতোসময় গভীরভাবে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। অর্চনা দরজার কাছে যেতেই কথা বলে প্লাবন
- তোমার কি মন ভালো নেই?
ঘুরে দাঁড়ায় অর্চনা - ভাল তো। কেন?
মৃদু হাসে প্লাবন - তবে সাদা পরলে যে? আজ তো আকাশের নীল পরার কথা। তাইনা?
সমস্ত দেহে যেন শিহরণ জাগে। প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে অর্চনা চোখ রাখে প্লাবনের চোখে। ওর ঠোঁটে বাঁকা হাসি আর চোখে মাদকতা ভর করেছে। আকাশের মতো রক্তিম আভায় ছেয়ে যায় অর্চনার মুখ। অপলক দৃষ্টির গভীরতা হৃদস্পন্দন তীব্র করলে অবাক হওয়া চোখ দুটো নামিয়ে নেয় অর্চনা।

-----------------------------------------------------------------------

১০/০৮/২০০৮

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]