\\ … মৃত মানুষের চিঠি … //

শহরের প্রান্তেই যে ঘাসফুল-জোনাকী-নদী-নৌকো-সাঁকো-আঁধার-ছাউনী ঘর থাকে, সে বুঝতেই শহরের উপান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম হয়তো! কিংবা আসলে পথ চলতে চলতে খুঁজে পেয়ে গেছি অন্য পথ… আমি নিছক পথই চলতে চেয়েছি কোনো বিষাদ গায়ে মেখে।

সঙ্কর বাসস্ট্যাণ্ড থেকে রিক্সায় চড়েই যদি রায়েরবাজারের পেছনের বেড়িবাঁধে গিয়ে দাঁড়ানো যায় তবে বোঝাই যায় না - যে শহরের রাস্তা-গলি-টঙ চায়ের দোকানে আড্ডা মারছি নিত্য এই সেই শহরই। কিংবা আজ বসিলা ব্রিজ পেরিয়ে যে গ্রামের অলিগলি ঘুপচি কাদা-কাদা পথ হেঁটে আসা গেল ঘোরে-বেঘোরে কেউ থাকুক মনে মনে ভেবে ভেবে…

অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখেছি নিজের মাঝে আমি, আমি মনে মনে অনেক দূরে কোথাও কোনো দিনে বসত গেড়ে বসে থাকছি কিংবা থেকেছি দিব্যি! এটা একটা রঙিন খেলাও তো বটে! এই যেমন জোনাক-জ্বলা পথ রিক্সায় পাড়ি দিতে দিতে ভেবেছি কে যেন থাকলে বেশ হতো আর তারপর মনে মনে আস্ত একটা দিনের পটে আঁকা ছবি… এসব নিয়ে চিঠি লেখাও যেন নিকোটিনে সুখ-টানের মতোন নেশা নিয়ে জাগে। আর তারপর কেন যেন ইদানীং মৃত্যু নিয়ে খেলতে-নাড়তে-ভাবতে-আঁকতে ইচ্ছে-ইচ্ছে করে।

এই যেমন ধরুন একটা হুট-হাট মৃত্যু কোথাও না কোথাও থেকে আছড়ে পড়লো… তার আগে আমি নাহয় ঘুরে এলাম সেই বেড়িবাঁধের বেড়া দেওয়া চায়ের দোকান যেখানে বসে বসে ভর বিকেলে তুমুল আড্ডা দিচ্ছিলো এক কিশোরী-এক মধ্যবয়সী নারী আর চায়ের দোকানদার … টুপটাপ বৃষ্টির জলে ভিজে যাওয়া বেঞ্চির গল্প তখন একটা চিঠি হয়ে যাবে…

আরেকটা গল্পে লেখা র’বে মধ্যচর-এর কথা… ব্রিজ পেরিয়ে মোহাম্মদপুর উঠে আসাকে যে এলাকার লোকেরা ‘ঢাকায় আসা’ বলে … যে খালে ঝাঁকাভর্তি মাছ ধরতে দেখে এলাম… পেছন-বাড়ির খোলা উঠোনটা যেখানে উদাম হয়ে ডাকে… তার আশেপাশের এক ভাঙাচোরা পোস্টাফিসের সিলে নাহয় ডাকবাক্সে থাকবে চিঠিটা…

এরকম ডজনখানেক চিঠি জমবে দু-তিনটে মফস্বলের – শহরের উপান্তের এ গ্রামে সে গ্রামের কিংবা এই শহরের কিছু এলাকার পোস্ট-অফিসে… লাল রঙা ডাকবাক্সে…
এবং চিঠিগুলো গ্রাম-গঞ্জ-পথ-ঘাট পেরিয়ে এ শহরে আসতেই থাকবে আসতেই থাকবে এ পথ-সে পথ পেরিয়ে… অদ্ভুতভাবে চিঠিগুলো সেই সেই পথ ধরে উঠে উঠে আসবে শহরজুড়ে ঠিক যেসব পথের ধুলোমাখা বাতাসে চোখ মুছে মুছে আমি নেমে গিয়েছি বার বার এ শহর ছেড়ে …

ধরে নিন তুমুল ঝড়-বৃষ্টি-জলোচ্ছ্বাস … সমাধির বালি কাদা-কাদা… আর আপনার দরজায় কেরানীগঞ্জ ঘুরে আসার সমাচার… কার বলার সাধ্যি থাকবে তখন আর যে আমি নেই?! কিংবা শীত-শীত সকাল কোনো… আগাছায় শিশির… কুয়াশা… আর আধ-চেনা কোনো গ্রামে শীত-সকাল কাটিয়ে আসার একটা প্ল্যান আর কিছু হিজিবিজি কথা পৌঁছে দেবে হঠাৎ কাঠ-খোট্টা কোনো পোস্টম্যান এই শহরের… যে শহরের রোদ প্রিয় পোট্রেট ছুঁয়ে যায় সে শহরের আপন গলিতে চা খেতে আসা হবে না আমার প্রিয় শরীরের … - এটুকু দুঃখ লেখা থাকবে না কোথাও হয়তোবা তখন আর… তখন কোথায় থাকে সেসব মানুষ… যাদের চিঠিরা উড়ে উড়ে বেড়ায় চেনা দরজাগুলোর ফাঁক-ফোঁকরে… যাদের চিঠি পেয়ে থমকে দাঁড়ায় কাছের কোনো মানুষ আর শিহরণে স্তব্ধ হয়ে যায়!

শহরে তখনও অনেক কবিতা পড়ে থাকবে … টুকটাক অনেকগুলো গল্প গলির মোড়ে-চেনা আড্ডায়-অচেনা মানুষদের জীবনে … ভ্যানগাড়িগুলো তেমনি সার-সার দাঁড়ানো ঠিক ঠিক আর যা বলা হয়ে যাচ্ছে সেগুলোই একেক জন একেক রকম ভাবে বলে বলে যাবে… নতুন নতুন অনেক চিঠিও জমবে পুরোনো অনেক চিঠির স্তুপের উপরে ……


একটা শালিক কিংবা কাক দেখা হবে না তখন আর আমার চশমা-পরা, কম-পাওয়ার এর প্রিয় চোখ দুটোর ক্লান্ত বিষণ্ন কোনো দুপুরে…


(৯ কার্তিক, ১৪২০)


মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
যেমন কবিতাময় হয় আপনার গদ্য, তেমনই হয়েছে। দেখা জগৎই যেন আবার নতুন করে দেখলাম।
বেশ তো! জমুক গল্প, চিঠি হয়ে কিংবা কাঠের বেঞ্চে বৃষ্টিজল হয়ে। তবু কাক-শালিকও জোড়-সংখ্যায় দেখা দিক বিকেল বিকেল।
দাদাভাই ... পড়লে যে এই তো বেশ ... :)
নীল বলেছেন…
কোনো সন্ধ্যায় বর্ষার শিশিরে অন্য এক দেখা আপনার… পথ-সাথীর অসঙ্গে ছিন্ন প্রিয়’র স্মৃতি
আনিস ভাই, দুঃখিত কেমন করে যেন আগে প্রকাশ করা হল না মন্তব্য ...
এখন দেখলাম ...
ভালো লাগছে পড়েছেন জেনে... :)
নীল'দা,
স্মৃতিকাতরতা প্রিয় হয়তো আমার...
এবং বিষাদও ...

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]