অবয়বের বৈচিত্র্য

কোন কোন মানুষ এতোটাই নগণ্য আমাদের এ সমাজে যে তাদের উপস্থিতিতে কারও কিছু আসে-যায় না। আমার - আপনার মতো তাদের মৃত্যুতে কেউ কেঁদে বুক ভাসাবেনা। তবু সমাজে তাদের উপস্থিতি স্বীকার করতেই হয়।
প্রিয় পাঠক, এমনই একজনের গল্প লেখার তাগিদ অনুভব করছি। শুরু থেকেই বলছি। শুরু অর্থাৎ সেদিনের কথা বলছি যেদিন থেকে তার নীরব উপস্থিতি অনুভব করছি।
কয়েকদিন থেকেই বাসার গেটের সামনে কে যেন কচুশাক রেখে যায়। সামনাসামনি দুটো বাসার গেটের সামনে সমানভাবে ভাগ করা থাকতো কচুশাকের গোছা। প্রথমে সবাই ভাবলো, ভাত খুঁজতে যে ছোট ছোট শিশুগুলো এবাড়ি-ওবাড়ি ছুটে বেড়ায় তাদের কাজ হয়তো। কিন্তু এই দুর্মূল্যের বাজারে তারা শাক কুড়িয়ে এনে কেন রেখে যাবে - তার সদুত্তর পাওয়া গেলনা।
কিছুদিন পর অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটলো। উপর তলার এক বাসার গেটের সামনে কে যেন একটি মৃত হাঁস আর পেঁয়াজ রেখে গেল। আরেকদিন একটি মৃত কাক। এবার বিল্ডিং এর সবাই গুরুত্বের সাথে ভাবতে লাগলো বিষয়টি নিয়ে।
অবশেষে একদিন খুঁজে পাওয়া গেল কে করছে এসব। বিল্ডিং লাগোয়া মুদির দোকানের দোকানদার দেখলো তাকে গেটের সামনে জিনিস রেখে যেতে। কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কী এমন অদ্ভুত কাজ অনবরত করে যাওয়া সম্ভব?

হ্যাঁ পাঠক, মানসিক ভারসাম্যহীন একজন এরকম আচরণ করছিলেন। বয়স খুব বেশি নয়, তরুণী বলা যায়। এলাকায় প্রায়ই দেখা যায় তাকে। ছোট ছোট চুল, অবসাদগ্রস্ত ম্লান অবয়ব। মলিন জামা থাকে গায়ে।
এরপর এভাবে অন্ন বিলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কখনও ফল, কখনও শাক কিংবা বিরিয়ানির প্যাকেট। জিনিসগুলো বাইরে পড়ে থাকতো, বুয়া কিংবা ভিক্ষুকদের ভাগ্যে যেত। একদিন দোকানদার জিজ্ঞেস করলো তাকে - এভাবে বাসায় বাসায় খাবার দিয়ে যাও কেন?
তার উত্তর - এ বাসার বউ-ঝিরা খুব কষ্টে আছে। তাই তাদের সাহায্য করছে সে।

আরও কিছু টুকরো ঘটনার কথা মনে পড়ছে তাকে ঘিরে।
ঈদ শেষে ফিরে এলাম ঢাকায়, দেখি বাসার সামনে নতুন শাড়ি রাখা। কখনও কখনও সে টাকাও রেখে যেত।
পাঠকবৃন্দ, একটি কথা জানিয়ে রাখি। মেয়েটির স্বভাবের যে বৈচিত্র্যের কারণে লেখাটি লেখার অণুপ্রেরণা পেয়েছিলাম তা হল - ভারসাম্যহীনতার মাঝেও হঠাৎ খুঁজে পাওয়া অবশিষ্ট আত্মসম্মানবোধ।

একদিন বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলেন পেয়ারা বিক্রেতার সামনে পেয়ারার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। বাবা ভাবলেন হয়ত ওর পেয়ারা খেতে ইচ্ছে করছে। তাই পেয়ারা কিনে তার হাতে দিলেন। হাত থেকে পেয়ারা নিল ঠিকই কিন্তু সাথে সাথেই পাশে দাঁড়ানো এক টোকাইকে দিয়ে দিল পেয়ারাটা।

এলাকার টিনশেডের চায়ের দোকান থেকে প্রায় প্রতিদিনই স্বেচ্ছায় মেয়েটিকে চা দিতেন দোকানদার। আবার হোটেলগুলো থেকেও খাবার দেয়া হয় ওকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যখনই মেয়েটা কোন পথিকের কাছ থেকে টাকা পায় তখনই কিছু না-কেনে টাকাগুলো দিতে যায় দোকানে।
আরেকদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। ‘হরিপদ মিষ্টান্ন ভান্ডার’ হোটেল চোখে পড়ে রেলিং এর ওপাশ থেকেই। হোটেলের কর্মচারীরা খুব ব্যস্ত ছিল সেদিন। হঠাৎ দেখলাম মেয়েটি এসে কি যেন বললো, খাবার চাইলো হয়ত। ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছিলো ছেলেগুলো। অবাক হয়ে দেখলাম বিন্দুমাত্র সময় অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করলো মেয়েটি। কর্মচারীরা অনেকবার ডেকেও ফেরাতে পারেনি তাকে। অবশেষে কয়েকজন কিছু খাবার নিয়ে তার পিছনে ছুটে গেল যদি গ্রহণ করে সে আশায়।

অবাক হয়ে ভাবি আত্মসম্মানবোধ, দায়িত্ববোধের কিছু থেকে গেছে অবশিষ্ট যা সে অর্জন করেছিলো জীবনের কোন এক পর্যায়ে। কিন্তু কখন, কোথায়, কি করে হারিয়ে গেল মানসিক ভারসাম্যটুকু, সে খবর কি কেউ জানবে কখনও?
মা বলেন - হয়ত অন্নের অভাবে দরিদ্র জীবন কেড়ে নিয়েছে ভারসাম্য।
আমি ভাবি - হবে হয়ত। নয়ত কার ঘরে অন্ন-বস্ত্রের প্রাচুর্য পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করে এ আকুল হৃদয়? দূর্বল মনস্তাত্বিক অবস্থার মাঝেও কার সাথে ভাগ করে নিতে চায় ঈদের আনন্দটুকু!
হয়ত মা-বাবা, ভাই-বোন অথবা কোন প্রিয়জন এখনও মেয়েটিকে খুঁজে ফিরছে তিলোত্তমা এই নগরীর রাজপথে। হাজার ব্যস্ততা শেষে অবসন্ন মুহূর্তে হয়ত এখনও কোন অশ্রুসিক্ত চোখ পথ চেয়ে থাকে তার আগমনের আশায়।

-----------------------------------------------------

১৩/৫/২০০৭

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]