ঘূর্ণিপাক

চিতার আগুনের আঁচে লালচে হয়ে যাওয়া পার্থ আজ বড় স্পষ্ট। সত্যি কী প্রচন্ড শক্তি ঐ টগবগে আগুনের। আস্ত একটা মানুষ গিলে খায় মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে। সংসার, সমাজকে ব্যঙ্গ করে দূরে, অনেক দূরে নিয়ে যায় কোন এক আপনজনকে। এক একটি চিতা ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করে দেয় চলমান জীবনকে, উৎফুল্ল সময়কে। ঝাপসা হতে হতে আরও স্পষ্ট হতে থাকে নববিবাহিত, তরুণ পার্থ মজুমদার। অফিসের হরেক ঝুট ঝামেলার শেষে বাড়ি ফেরার পথে নানান ঝক্কি পোহানোর কষ্টগুলো তেমন একটা গায়ে লাগেনা তখন। বরং বাড়ি ফিরতে হবে ভাবলেই অদ্ভুত এক শিহরণ খেলা করে সমস্ত শরীরজুড়ে। ঘরের প্রতিটি কোণায় শুধু নোনা স্বাদ গন্ধ। পরে, অনেক পরে যে দারিদ্রতা অনেক বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তা কি ছিল না তখন। ছিল ঠিকই, তবে দিনযাপনের কষ্টগুলো বড় তুচ্ছ ছিল সুখময় পরিতৃপ্তি আর নানান রঙের সময়ের কাছে। এক পা, দু পা করে এগিয়ে যায় সময়। ধীর গতি বলা চলে কি-ভাবতে থাকে বিধ্বস্ত, শ্রান্ত এক পার্থ মজুমদার। সময় কি কখনও কাউকে অতোটা দয়া করে? সুখের মুহূর্ত, আনন্দের উত্তাপ এক পলকে সমাপ্ত করাটাই কি সময়ের ধর্ম নয়?
ঝাপসা সময় উপভোগ্য খেলায় মেতে উঠে। পার্থ মজুমদারের চোখের সামনে তখন অপূর্ব এক ষোড়শী কন্যা। শ্যামবর্ণ মুখের মায়াভরা দুচোখ দীপ্তি ছড়ায়। দীঘল কালো চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়তে থাকে। ওর মায়ের বড় শখ ছিল মেয়ের চুল হবে হাঁটু পর্যন্ত। মায়ের স্নেহে ঢাকা যত্নে অথবা অমরা থেকে ধার করে আনা গুণের কারণেই বোধহয় মেয়ের চুলগুলো পিঠকে স্পর্শ করে ছুটে যেত কোমর অবধি। এই ষোড়শীই একদিন শিশুকন্যা হয়ে আনন্দের বর নিয়ে এসেছিলো।
-‘অবনী’, আমার মেয়ের নাম হবে অবনী। এ্যাই, ওকে কিন্তু নাচ শেখাবো। গানও জানবে ও।
একমাত্র মেয়েকে ঘিরে স্বপ্নেরা ডানা মেলে। খিল খিল হাসিতে চারণভূমি তখন শ্যামলীমায় ভরপুর। কষ্টগুলো আবার ম্লান হতে থাকে। তবে সুখও বোধ করি ক্লান্তি এনে দেয় একসময়।
আকাশের দিকে তাকালে অনেক তারা চোখে পড়ে। পার্থ ভাবে-সবগুলো গ্রহ নয়। আজকাল বেশির ভাগই স্যাটেলাইটের আলো।
আকাশে মেঘ নেই। চাঁদ আর তারার আলোয় আশ্চর্য এক স্নিগ্ধতার পরশে পার্থ ভুলেই গিয়েছিলো যে শ্মশানে বসে আছে সে এখন। তারা দেখতে শিখেছিলো পার্থ। এমন জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে ছোট্ট বেডরুম থেকে বেরিয়ে আরও ছোট বারান্দায় এসে বসতো প্রতিমা। বিশাল শূণ্যতার আধার বিছানাটি যেন শ্বাসরুদ্ধকর ভাব জাগাতো। তাই মাদুর পেতে বসে থাকা প্রতিমার গায়ে গা ঘেঁষে বসতো পার্থ। এই বারান্দা প্রতিমার খুব পছন্দ। অর্ধেক সিমেন্টের রেলিং আর উপরের অংশে মুক্ত বাতাসের অনধিকার প্রবেশ। প্রতিমার মোহময় চোখ দুটোতে আবেশ জড়ানো মুগ্ধতা এনে দিত রাতের আকাশ। পার্থর কাঁধে মাথা এলিয়ে প্রতিমা বলে যেত সপ্তর্ষিমন্ডলের গল্পকথা। সাতটি তারা-অঙ্গিরা, মরীচি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু আর ঋষি বশিষ্ঠের পাশে অরুন্ধতী .....। প্রতি রাতে মাতাল হতে হতে জীবনকে বড় উপভোগ্য মনে হতো।
দ্বিতীয় একজনের কাছেও রাতের আকাশ দেখতে শিখেছিলো পার্থ মজুমদার। স্পষ্ট মনে পড়ে, কখনও স্বীকার করেনি যে কোন এক প্রথমা আগেই তাকে শিখিয়েছে, চিনিয়ে দিয়েছে সপ্তর্ষিমন্ডল।

এমনিতেও নীরার সাথে কথা বলার সময় প্রয়োজন ছাড়া প্রতিমার নাম মুখে আনতো না সে। সুবিন্যস্ত বাড়ির এ্যাটেস্টড ছাদে বসে প্রজাপতিকন্যা অরুন্ধতীর কথা বলেছিলো নীরা। অরুন্ধতী, সপ্তর্ষিমন্ডলের অন্যতম ঋষি বশিষ্ঠের পতিব্রতা পত্নী। সতীসাধ্বী পত্নী হওয়ার জন্যই তিনি ঠাঁই পেয়েছেন স্বামীর পাশে-বলতে বলতে হঠাৎ বিষণ্ণ,পাণ্ডুর হয়ে উঠেছিলো নীরার মুখখানি। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলো -ওগো, বলতো ‘কবুল’ বলে, কাগজে সই করে গ্রহণ করা সম্পর্কই কি শুধু মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য? আবেগের অলিখিত সম্পর্কের কি কোন মূল্য নেই?
‘ এ সমাজে নেই।’-অনেকটা ভাবলেশহীনভাবে কথা বলেছিলো পার্থ।
ডুকরে কেঁদে ওঠে নীরা-তাহলে সাতপাকে বাঁধা প্রতিমার ভালবাসাই সব। আমারটা ফেলনা। আমি কেউ নই। কিচ্ছু নই?
ঝরঝর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে বাধা দেয়না পার্থ। ক্ষত মুছে যাবেনা, কিন্তু অশ্রুর স্রোত হৃদয়ে ক্লান্তি এনে দিলে কষ্টগুলো সাময়িকভাবে ম্লান হয়ে যাবে। পার্থ জানে, এ কান্না ওর জন্য নয়। প্রতি পদে যোগ্যতা প্রমাণ করে সাফল্য ছিনিয়ে নেয়া, প্রতিষ্ঠিত, স্মার্ট নীরা পরাজিত আজ ‘অরুন্ধতী’র কাছে। নীরাও একসময় বড় স্বামী সোহাগী ছিল। ‘একসময়...’ মনে মনে আওড়াতে থাকে পার্থ মজুমদার। একটা সময়ের পর সবকিছু ওলটপালট হওয়াটাই বোধহয় স্বাভাবিকতা। অস্থির সময় মনকে অস্থির করে তোলে। স্থিতিশীল ভালবাসা তখন নড়বড়ে। তাই প্রতিমা তখন অতোটা গভীর কোন শিহরণ নয়। তবু কোথায় যেন অজানা আতঙ্ক শিড়দাঁড়া বেয়ে উঠতো মাঝে মাঝে। এক অভ্যস্ততায় পরিণত ‘টান’ ঘরে ফিরিয়ে আনতো রাত্রি দ্বিপ্রহরে। দরজা খুলে দিত প্রতিমা। শান্ত, ধীর চোখদুটোর প্রশ্নহীন দৃষ্টি পার্থকে প্রচন্ড অপরাধবোধে সঙ্কুচিত করতো। হাতে ধরে থাকা বইয়ের ভাঁজে হাত রেখে প্রশ্ন করতো প্রতিমা-ভাত দিব?
বই পড়ার নেশা ছিল ওর সবসময়। তখন প্রবল হল। হয়ত একাকীত্বে কোন অবলম্বন খুঁজে নিতে সঙ্গী হয়েছিলো বইগুলো। প্রতিমা কোনদিন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে রাগান্বিত প্রশ্ন ছুঁড়ে আঘাত করেনি। কখনও জানতে চায়নি এতোরাত কোথায় কাটে পার্থর। কে জানে, হয়ত সবই জানতো প্রতিমা। সংসারের প্রথম প্রহরে পার্থর উদ্বেগ, ক্ষুধা, প্রশ্ন, কামনার কথা চোখ দেখে বলে দিতে পারতো প্রতিমা। মাঝে মাঝে পার্থর অবাক চাহনির উওরে মিষ্টি হাসিমুখে পার্থর ঘন,কোকড়া চুলে আঙুল চালিয়ে বলতো-মেয়েরা অনেক কিছু বুঝে নিতে জানে।
কথাটি বোধহয় সত্যি ছিল, নয়ত নীরার প্রতি দুর্বার আকর্ষণের দিনগুলোতে প্রতিমা প্রায়ই কেন বলতো-ভালবাসা আদায় করা যায় না। শুধু গ্রহণ করা যায়। অধিকারের দোহাই দিয়ে ঘর বাঁধা যায়, প্রেমতো নাগালের বাইরে থাকে।
প্রখর আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রতিমার। ওর আরও একটা গুণ ছিল, এতোটুকু সংকীর্ণতার ঠাঁই ছিলনা মনে। পার্থ মজুমদারের দিনগুলো তাই অসহ্য যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠছিলো দিন দিন। প্রতিমা যদি অধিকারের দাবীতে হিংস্র হয়ে উঠতো তবে কিছুটা স্বস্তি থাকতো কোথাও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা শেক্সপিয়ার নিয়ে রাত কাটিয়ে দেয়া প্রতিমার নীরব প্রতিবাদ অপরাধ, অপমানের গহীনে ছুঁড়ে ফেলেছিলো ওর অস্তিত্বকে। স্কুলের শিক্ষয়িত্রী, লেখিকা প্রতিমা মজুমদার ওর পৌরুষকে ব্যঙ্গ করছিলো প্রতিনিয়ত।
রাত বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হিমেল হাওয়ার দাপট। খুশ্খুশে কাশি আজকাল ওকে খুব কাবু করে ফেলে। মলিন চাদর গায়ের সাথে জড়িয়ে নেয় ভালভাবে। অবনীর মুখ মনে পড়লে মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মন আজ কেঁদে কেঁদে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। অবনীর ঘর থেকে বেরিয়ে এই শ্মশানে এসে বসা। প্রায় রাতেই আজকাল শ্মশানে আসে পার্থ, ঠিক যেন সেই কবেকার দীর্ঘ দিনের পরে প্রতিমার কাছে ফিরে আসা। সামনে এখনও চিতার আগুন জ্বলছে। এমনই লেলিহান দাউ দাউ আগুনে এখান থেকে চলে গিয়েছিলো প্রতিমা। মানুষের মন বনে-বাদারে লাফিয়ে বেড়ানো বানরের মতো। কোন ভাবনাই স্থিরতা পায়না। কখন যে কে উঁকি দেয়, আগে থেকে বোঝা বড় দায়। এই রাতের আঁধারে আজ এতোকাল পরে নীরা কী করে যে ফিরে এল। অবনীকে দেখে প্রতিমার মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো মনে, এরপরই নীরা।
এখন একাকী সন্ধ্যা বিষণœতায় ডুবিয়ে রাখে। একা, একাকীত্বই জীবনের শেষ পর্যায়। একাকী নিজেকে নিয়েই আজ পার্থ মজুমদারের সংসার। পাড়ার চায়ের দোকানে সন্ধ্যা পার করে রাত দশটায় যখন ঘরে ফিরে, একটা-দুটো ইঁদুর ছাড়া ঘরে তখন আর কেউ থাকেনা। তাই আজ আড্ডা শেষে অবনীর বাসায় একবার ঢুঁ মারে। মেয়েটাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে হয়। রটনা, চমকপ্রদ গুজবে মানুষের আড্ডা ঠাসা। নানা কানাঘুষায় মন অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। কিন্তু কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে দিতে অবনীর দৃষ্টি চমকে দেয়।
‘বাবা,তুমি? ভাল আছতো?’-অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকায় অবনী। অতি পরিচিত এই চোখ দুটো যেন বহুকাল আগের স্মৃতিতে ধরা দেয় পার্থ মজুমদারের কাছে। ঘরে ঢুকে নিশ্চিত হয় পার্থ, বাসায় নেই সুমিত। অফিসের কোন সুন্দরী সহকর্মীর সাথে লং ড্রাইভে যেতে দেখা গেছে তাকে-কথাটি গুজব নয়, সত্য। প্রায় রাত মেয়েটির বাসায় কাটায় সুমিত। অবনীকে কিছু বলা হয়না। মন থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলোকে নিষ্প্রয়োজনীয় মনে হয়। কড়া এক কাপ চা খেয়ে উঠে আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অবনীর জিদের কাছে হার মেনে রাতের খাবার খেতে বসতে হয়।
‘ বাবা, আজ নাহয় থেকে যাও?’- কৃত্রিম হাসি আর কন্ঠস্বর ছাড়িয়ে পার্থর সামনে প্রতিমার প্রতিচ্ছবি তীব্র হয় অবনীর অস্তিত্বে। অবনী আজ প্রতিমার জায়গায় দাঁড়িয়ে। মনের অস্থিরতা গোপন করে, কাজের দোহাই দিয়ে বের হয়ে এসেছিলো পার্থ। ছুটে এসেছিলো শ্মশানে।
পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে একসময় একই জায়গায় আসে, যেখানে বহুকাল আগে কোন এক মুহূর্তে ছিল। শ্মশানের স্তব্ধতায় ভাবনাগুলোতে আচ্ছন্ন হতে হতে ম্লান হাসে কোন এককালের ছাপোষা পার্থ মজুমদার।

------------------------------------------------------------------------------------
২৩/৩/২০০৮

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]