অস্তিত্বে কুহেলিকা

রাতের প্রহরগুলো গুনতে গুনতে রাত কাটিয়ে দিতে বেশ লাগে উজানীর। ঠিক যেন অবজ্ঞাভরে ফিরিয়ে দেয়া রাতের ঘুম জড়ানো মুহূর্তের আহ্বান। ‘অবজ্ঞা’ শব্দটি বুকের ভিতর ঝড় উঠালে চিনচিনে ব্যাথায় খানিক কুঞ্চিত হয় কপাল। একটা দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘায়িত করে নিঃশ্বাসের নির্দিষ্ট সময়। তবু সব শেষে সেই অবজ্ঞারই হাসি ফুটে ওঠে উজানীর কালচে মোটা ঠোঁট দুটোতে। মিষ্টি হালকা আলো মেখে আকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কর্কশ কা কা ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। রোজ রোজ এমন করেই সকাল আসে। তবু নতুন একটা দিন, জীবনের আরও একটা সকাল এটি। বাঁশের দুটো টুকরো আড়াআড়িভাবে বসানো নড়বড়ে জানালা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় উজানী। অবিন্যস্ত আচল মাটিতে লুটায়, বুকে তুলে নেওয়ার কোন তাগিদ অনুভব করে না। বরঞ্চ ব্যস্ত হাতে কোমরে জড়িয়ে নেয় কাপড়টি। চঞ্চল গতিতে টিউবয়েলের দিকে এগিয়ে যায়। এখনও ওতো ভিড় জমেনি কলপাড়ে। একটুপর হই-হুল্লোড় শুরু হবে এখানটায়। লাইনে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গে উজানী।

দূরের আকাশ তখন লালচে আভায় মোহনীয় হয়ে উঠছে। গ্রামের তালগাছটার মাথার পরে আকাশটা ঠিক এমন হয়ে আছে এখন। ‘মোহনভোগ’ - অপূর্ব নামের অনিন্দ্য সুন্দর গ্রামটি যন্ত্রণার তীব্রতা নিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্মৃতিতে। মা-বাবা, ভাই-বোন, পরিচিতজন, যাদের সাথে ভালবাসার-শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। যারা অস্তিত্বের, অনিশ্চিত পরিচয়ের সংকটের মাঝে একা ছেড়ে দিয়েছিলো তাকে তাদের কথা বড় বেশি মনে পড়ে। দেখতে দেখতে চঞ্চল হয়ে ওঠে বস্তিপাড়া। উজানী দাঁতের উপর আনমনে ছাই ঘষতে থাকে। চোখে মুখে পানির ঝাপটা মেখে ঝুপড়িতে ঢুকে। একটা নড়বড়ে খাটিয়া, মরচে ধরা পুরনো ট্রাঙ্ক, পেরেকে ঝুলে থাকা চারকোণা আয়না - এই নিয়ে সীমাবদ্ধ জগৎ উজানীর। আয়নার দিকে তাকাতেই প্রতিচ্ছবি ধরা দেয় চোখের সীমানায়। লম্বাটে শ্যামলা মুখ, পুরুষালী দুটো কালচে ঠোঁট আর টানা দুটো ভ্রুর নিচে ঘন পাপড়িসমেত চোখ। বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। নিষ্পাপ এক শৈশব ঝলকে উঠলে ছোট্ট উজানী নদীপাড়ে ছুটে বেড়ায়। এক্কা-দোক্কা, পুতুল খেলায় মেতে থাকে দুরন্ত শিশু। পুতুল খেলায়, চুলে গামছা বেঁধে মেয়ে হয়ে যাওয়ার পেছনে মায়ের শঙ্কিত মুখখানি মনে পড়ে। নিজের জীবনই নিজের কাছে অদ্ভুত এক ধাঁধাঁ হয়ে দাঁড়ায় একসময়। ধীরে ধীরে নিজের ভিতর দুপ্রান্তের দুটো পৃথক জগৎ প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে ধরা পড়ে বয়ঃসন্ধিকালে। গ্রামের মানুষ অবশ্য বুঝতে পারে আরও কিছুদিন পরে। এরপর কী করে এক নির্দিষ্ট পরিচয়হীন প্রাণীর সাথে তারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের মিশতে দিতে পারেন? সত্যিই তো -আনমনে ভাবে উজানী। খুব বেশি করে মনে পড়ে সাবরিনার কথা। অনেক ভালবাসতো ওকে। আজও স্পষ্ট শুনতে পায় মায়ের আর্তনাদ। গ্রামের বৈশাখী মেলায় কিন্নরদের দলটার হাতে ওকে তুলে দিতে বাধ্য মা-বাবার করুণ মুখ আর ভাইবোনদের স্বস্তিমাখা চোখ বড্ড মনে পড়ে হঠাৎ। তবে হ্যাঁ, ঠিক দাঁড়াতে পেরেছিলো। সবকিছুকে পেছনে আড়াল করে একটা নতুন জগৎ, নতুন নাম নিয়ে ভুলেই তো ছিল। তবু মনের গহীন কোণে কোথায় যেন, বার বার, বারংবার ফিরে আসা জ্বালাময় অতীত ..........।

দূর্গার ডাকে চমক ভাঙ্গে উজানীর।
সুরুজ হাসপাতালে, অবস্থা খুব খারাপ। - বিষণœতায় আর ক্লান্তিতে ডুবে আছে দূর্গার কন্ঠ। সুরুজ ওদেরই দলে ছিল। কিন্তু কদিন আগেই এক সাহেবের সখ্যতায় বেশ কিছু টাকা পেয়ে অপারেশন করিয়েছে। একটা নতুন জীবনের স্বাদ, কোন প্রিয়জনের আহ্লাদ গ্রহনের সাথে সাথে যমদূতও কড়া নাড়ে ওদের জীবনে। তাই সুরুজের জীবনে মৃত্যু এখন অনাকাঙ্খিত নয়। ভালই হবে, ভাবে উজানী -বেঁচে গেলে কোন না কোন পুরুষের সাথে জীবনকে গেঁথে নেবে। আর মৃত্যু হলেতো অসীম প্রশান্তিতে জড়িয়ে যাবে। তাই সুসংবাদ কিংবা দুঃসংবাদটির কথা না ভেবে প্রসাধন মাখতে ব্যস্ত হয় উজানী। কাজল, মাশকারা আর আইলাইনার এ মোহনীয় হয় চোখ দুটি। মনে পড়ে চঞ্চল, তরুণ সেই লেখকের কথা। কিণ্ণর - কিণ্ণরীদের নিয়ে এক উপন্যাস লেখার প্রয়োজনে বেশ কিছুদিন ওদের জীবনের সাথে এসে মিশেছিলো। প্রায়ই বলতো- ‘জানেন উজানীদি, আপনার চোখ দুটো অদ্ভুত সুন্দর। আপনার বডি স্ট্রেকচার অনেকটা আফ্রিকান নারীদের মতো। সত্যি, বিশ্বাস করুন, প্রথমবার দেখে বুঝতেই পারিনি আপনি ওদের সাথের একজন।’
উচ্চহাস্যে থামিয়ে দিত উজানী তাকে। কিন্তু ওর কোমর ছোঁয়া সিল্কি চুল, অন্যদের চেয়ে আকর্ষণীয় ফিগার আর গুরু মার (হিজড়া দলের দলপ্রধানকে এ নামেই ডাকেন তারা) একটু বেশি স্নেহ এখানকার অনেকেরই মনে ঈর্ষার উদ্রেক ঘটায়। জানে উজানী এ কথা।

দোকানদার কিংবা অন্যদের কাছ থেকে চাঁদাও সে বেশিই জোগাড় করতে পারে। তবুও তো পূর্ণাঙ্গ নারী নয়। নারীত্বের গৌরব কেন দিলেন না বিধাতা? উদাসীনতা জড়িয়ে ধরলে চিরুণি থমকে দাঁড়ায় চুলের গোছায়।
‘ আ ! মর, এখনও শ্যাষ হইলনা সাজন-গোজন। তোর আশায় বইস্যা থাইক্যাতো মরদগুলানের পায়ে শিকড় গজাইয়্যা যাইবো।’

কল্লোলিত হাসির দমকে প্রাণের উচ্ছ্বলতা ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়। সর্বাঙ্গে উচ্ছ্বাস মেখে ঘরে ঢুকে সরমা, রাণী, পাখি, চপল আর যমুনা। দুঃখগুলো যেন খাঁচাছাড়া পাখি হয়ে উড়ে যায় পলকে। আজ এলাকা ঘুরে একবার নিউমার্কেটেও যেতে হবে। ছয়জনের দল তাই বেরিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। কেউ সহানুভূতি দেয়, কেউ দেয় বিরক্তি কিংবা ঘৃণা। আর কেউ কেউ শাপ-শাপান্তের ভয়ে গুঁজে দেয় কিছু টাকা। এমনি করে পড়ন্ত বিকেলে পোস্ট-অফিসের সামনে আসতেই ঝুম বৃষ্টি নামে আকাশজুড়ে। ‘হায় দাইয়্যা’ - বলে দৌঁড়ে ভেতরে ঢোকার পথে যমুনাকে বলে রিকশাগুলোর লাইন ঠিক করতে থাকা এক লোক -‘তোরাতো দেশটারে জ্বালাইয়া মারলি।'
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘুরে দাঁড়াতেই ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে যমুনার কন্ঠে - ‘যেদিন তোর মন্ডুটা চিবাইয়্যা খামু , সেদিন জ্বালা কারে কয় বুঝবি ।’
আশেপাশের মানুষগুলোর কেউবা ভ্রু কুঁচকে তাকায় আর কেউ নিঃশব্দে হেসে যায়। আর তখন পথ চলতে থাকা কিণ্ণরদলের উচ্চকিত উচ্ছ্বাস যেন ব্যঙ্গ করে এ-সমাজের সভ্যগোষ্ঠীকে আর বিধাতার নির্মম এই ‘এক্সপেরিমেন্ট’-কে।

-----------------------------------------------------------------------------

১২/০৮/২০০৮

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]