রাজপ্রাসাদের বর্ণমালা

এ জায়গায় অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে সে। ধীরে ধীরে কোলাহল থেমে নিরিবিলি হয়ে গেছে চারপাশ। কেউ আছে কিনা ঠিক ঠাহর করা যায়না। অনেকসময় মানুষ ওকে দেখলেও সাড়া দেয়না। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়, আরও আস্তে পথ চলার চেষ্টা চালায়। দ্রুত হাঁটতে ভয় হয়, যদি পড়ে যায়। তার প্রতিদিনকার একঘেয়ে আবেদনে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। কেউ নেই হয়ত। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। শরিফা না আসা পর্যন্ত কোথাও যাওয়া যাবে না। খুব সাবধানে বসে হাত দিয়ে দেখে, অনুভব করে শক্ত পিচ ঢালা শিশির ভেজা রাস্তার স্পর্শ। ভাললাগার সাথে সাথে বিষন্নতার ভারে কেঁদে ওঠে মন। চোখের সামসে ভেসে ওঠে একটুকরো সত্যিকারের স্মৃতিকথা নাকি রূপকথার গল্প মনে পড়ে যায় তার।

পলেস্তরা খসে পড়ে রংটা বিবর্ণ হয়ে গেছে জমিদার বাড়ির। শ্যাওলার নিচে ঢাকা পড়েছে জমিদারী বৈঠকখানা, পুজো মন্ডপ আর প্রতাপশালী জমিদারিত্ব। তবু কোন এক অতীতের অহংবোধ এ বাড়িকে দিয়েছে স্বকীয়তা। ছুট্ ছুট্ ছুট্ করে বাড়িটা মাথায় তুলছে কয়েকটি শিশু। আদিম বাড়ির ভিতর পুরাতনের ছাপ বয়ে বেড়ানো কয়েকটি ঘর। এখন আর তেমন কোন দামি আসবাব নেই এখানে। যদিও প্রতিরাতে শিশুগুলো স্বপ্নে রাজকন্যা কিংবা যুবরাজ হয়ে যায়; আর তখন এ বাড়ি হয়ে যায় প্রাচুর্যময় রাজপ্রাসাদ। তবে মানবজনের অভাব নেই এখানে যদিও সবাই একই পর্যায়ের নয়। কেউ সত্বাধিকারী, কেউ আশ্রিত, কেউ অতিথি আর কেউ বা সামান্য বেতনভুক্ত কর্মচারী।

বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন সাদা থান পরিহিতা আশির্দ্ধো বৃদ্ধা। শীতের সকালের মিষ্টি রোদে বসে ঠাকুরের নাম জপছেন তিনি।
ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে আসে বর্ণমালা আর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে - দিদা কি কর?
মায়াবী বোলে প্রশান্তি ছড়িয়ে যায় বৃদ্ধার চোখে মুখে - এইতো ঠাকুরকে স্মরণ করছি।
এবার চোখ যায় বারান্দার পশ্চিম কোণে, ফর্সা রঙের, মোহনীয় গড়নের তন্বী তরুণী বারান্দা ঝাট দিচ্ছেন। তারও পরনে সাদা থান কাপড়। তার পরিচয় তিনি একজন সদ্য বিধবা। তিনি অতিথি নন। আবার সত্বাধিকারীও নন। কিন্তু আশ্রিত বলতেও কোথায় যেন বাঁধে কারণ একতরফাভাবে কেউ তাকে দয়া করছেনা। তিনি বাড়ির কাজগুলো করেন। রান্নাঘরের কাজগুলোর দায়ভার তার উপরই তবু তিনি বেতনভুক্ত নন। বলা চলে কর্মের বিনিময়ে আশ্রয় তার কাম্য। আসলে তিনি এ বাড়ির বড় বৌরাণীর ছোট বোন। ছোটবেলা তার নাম রাখা হয়েছিলো মানবিকা। তবে এ নামে এখন আর কেউ ডাকে না। বড়রা ডাকেন মনু, ছোটরা মনুদি। কিন্তু তিনি হলেন বর্ণমালার আদরের ছোট মা। বর্ণমালার বেশিরভাগ আবদার তাকেই পূরণ করতে হয়।

রান্নাঘরে মাসের আনাজপাতি এসেছে, ব্যস্ত সবাই। ছোটমার হাতে হিশেব বুঝিয়ে দিচ্ছেন মা। আর ছোট মা বুজির হাতে তুলে দিচ্ছেন মালমশলা, চাল, ডাল আরও কত কি। মা’র পিঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্ণমালা। মার সুতির শাড়িতে কী সুন্দর আদর আদর গন্ধ। আর বুজি শুধু ওলোট পালট কাজ করে বকা খাচ্ছে মার কাছে।
ও! বুজির কথাতো বলাই হয়নি। বুজি যে সেই কবে এ বাড়িতে এসেছে তা- মনেও নেই কারও।
বর্ণমালা জন্মের পর থেকেই তাকে দেখেছে। বুজি রান্নাঘরে থাকে, অন্যসব বাবুর্চি, বুয়াদের উপর খবরদারি করে আর মাস শেষে বেতন পেলে তা জমিয়ে রাখে। পূজো-পার্বণের ছুটিতে যখন অন্য সব কর্মচারী বাড়ি যায় বুজি তখনও এখানেই থেকে যায়। কেউ বাড়ি যেতে বললে বলেÑ এটাই তার বাড়ি, যে ছেলে তাকে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে গেছে তার কাছে ফিরবে না কিছুতেই।

উঠানের আম গাছের পরে আর একটা ঘর, সবাই বলে ‘পেছন ঘর’। সেখানেও থাকেন একজন। তিনি হলেন একধরণের অতিথি। ‘একধরনের’ কারণ তাকে ইংরেজিতে বলে “পেইং গেস্ট’’। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘ভাড়ার অতিথি’। তার নাম অভ্র আলম অর্ক, খুলনা থেকে এসেছেন এই ঢাকা শহরে বিদ্যা শিক্ষার তাগিদে। ছুটির দিনে ক্লাস টুতে পড়–য়া বর্ণমালাকে মজার মজার খেলা শেখান। তবে প্রধান লক্ষ্য খেলা করা নাকি বর্ণমালাকে ঘরে নিতে আসা মানবিকাকে একঝলক দেখার তা বিধাতাই জানেন। এই মুসলমান ছেলেটিকে ঘরে রাখার পক্ষে ছিলেন না মা কিছুতেই। হোক পেছন ঘর, তাতে কি। খাবার দাবার তো এখান থেকেই যাবে। ছোঁয়াছুঁয়ি হলে তখন উপায়! কিন্তু অবশেষে বাবার ইচ্ছার কাছে হার মানতে হয় মাকে। কিছু কড়া কথাও শুনতে হয় বাবার মুখে - ‘তুমি যে যুগে বেঁচে আছ সে যুগ এখন আর নেই, বুঝলে। একটা ছেলে থেকে খেয়ে পড়াশোনা করবে তাতে দোষের কি?’
তবে মা শর্ত দিয়ে দেন - ভেতর ঘরে ঢোকা নিষেধ। বাসন-কোসনও আলাদা করে রাখা হল। ও ঘর থেকে আসার পর গঙ্গাজল দিয়ে ধোয়া হলে তবেই রান্নাঘরে ঢোকার অনুমতি পায় বাসনগুলো। তাতে বর্ণমালার কী এসে যায়, দুরন্ত বর্ণমালা প্রায়ই মায়ের চোখ এড়িয়ে পৌঁছে যায় এঘরে। অর্কদার হাতে তৈরি কাগজের খেলনা বাড়ি, গোলাপ, নৌকা, উড়োজাহাজ পেতে খুব ভাল লাগে। আর হঠাৎ কখনও ধরা পড়লে ছোটমাতো আছেই বাঁচানোর জন্য।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বর্ণমালার দৌরাত্ম্য চলে বাড়িময়। শুধু স্যার পড়াতে এলে অনিচ্ছাসত্বেও পড়ার টেবিলে গিয়ে বসতে হয়। খেলার সাথী ওর অনেক। পাশের বাড়ির দূর্গা, অন্তু, চামেলী আর বাসায় আছে কালী, রমা, বিন্দু।
কালী, রমা, বিন্দু হল পিসিমনির মেয়েরা। পিসু আর পিসিমনি অতিথি হয়েই এসেছিলেন যখন নদীর ভাঙনে তাদের বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে যায়। কিন্তু আসার কয়েকদিনের মাথায় পিসু স্ট্রোক করলে অচেনা শহরে তাদের এ বাড়ি ছাড়া আর কোন সম্বল থাকেনা।
বাবা এ বাড়ির কর্তা। বাবার কথাতেই সব হয়। জমিদারী নেই, কিন্তু এ রাজ্যে বাবাই জমিদার। বাবা সবার ভালমন্দ বোঝেন, দেখেন।

সামনে দূর্গোৎসব, তাই বাড়িতে প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে। সবার জন্য কাপড়, বাড়িতে নতুন কুশন, বেডসীট সবকিছু কেনা হচ্ছে। উৎসবের আমেজে সারাদিন মজে থাকে বর্ণমালা। বর্ণমালার খুশি আলাদারকমের। সবাই ওর জন্য নিয়ে আসছে নতুন নতুন জামা, জুতো, খেলনা। মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে বেড়াবে, প্রতিমা দেখবে, মেলা থেকে কিনে আনবে নানান রকম জিনিস। ছোট মার সাথে এর মধ্যে শুরু হয়ে যায় প্ল্যান-প্রোগ্রাম করা। কোন মন্ডপে কোন দিন যাবে, কোথায় কোথায় মেলা বসবে সব নিয়ে মহাব্যস্ত এখন বর্ণমালা।
ছোট মার কথামতো বর্ণমালার জন্য অর্ডার দেয়া হয় লাল চুমকির কারুকাজ করা লেহেঙ্গা, কেনা হয় লাল চুড়ি, পায়েল, টিকলি আরও কত কী। বর্ণমালার খুশি আর ধরে না। ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সময় এইসব পরবে বর্ণমালা।

দেখতে দেখতে পূজা এসে যায়। আগে এই বাড়িতে বিশাল প্রতিমা আসতো। দূর দূর থেকে মানুষ আসতো সেই প্রতিমা দর্শনে। এখন আর সেসব নেই। বাবার বেতনের টাকায় এখন আর সেসব হয়না। তবু যেটুকু হয় তাইবা কম কিসে? বর্ণমালা আর বাসার সবাই এতেই খুশি।
মহাঅষ্টমীতে খুশি ঝলমল বিকেলে বাবা আর মায়ের সাথে ঠাকুর দেখতে বেরোয় বর্ণমালা, কালী, রমা আর বিন্দু। বাবার কোলে চড়ে মন্ডপগুলোর নানান রকমের নানান সাজের প্রতিমা দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বর্ণমালা। মাটির পুতুল কেনার বায়না ধরে বাবার কাছে। বাবা কোল থেকে তাকে নামিয়ে হাতে দিলেন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাটির পুতুল। তারপর বাবার হাত ধরে ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছিলো মেলা চত্বর।

কিন্তু, কী যেন দেখেছিলো, যার আকর্ষণে থমকে দাঁড়িয়েছিলো। মনে করতে কষ্ট হয় বর্ণমালার। অবশেষে মনে পড়ে, সুতোয় বাধা গোল বল। একটা লোক বিক্রি করছিলো বলগুলো, সুতো ধরে ঘুরাতেই কি সুন্দর আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিলো বল থেকে। আলো-আধারির খেলার মাঝে ডুবে যায় বর্ণমালা। কিছুক্ষণ পর বাবার হাত ধরার জন্য হাত বাড়াতেই দেখে বাবা পাশে নেই। চারপাশে শুধু অচেনা মানুষ। কত মানুষ, কিন্তু বর্ণমালা বাবাকে কোথাও খুঁজে পায়না। নোনা জলে টুকটুকে লাল দুটো গাল ভিজতে থাকে অনবরত। হঠাৎ চমকে উঠে বর্ণমালা। মাইকে ওর নাম ধরে ডাকছে, বলছে কোন পুলিশের কাছে গিয়ে পরিচয় দিতে। কিন্তু কোন পুলিশের কাছে যাবে সে, কোথায় পুলিশ। বিভ্রান্ত বর্ণমালার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে পূজোর আনন্দ উল্লাসের জোরালো শব্দে। এর মাঝে এক মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে আসে। স্নেহমাখা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে - কি হয়েছে বাবু?
‘আমি হারিয়ে গেছি। আমাকে মাইকে ডাকছে। আমি বাবার কাছে যাবো।’ - কান্নায় ভেঙে পড়ে বর্ণমালা। লোকটি কোলে তুলে নেয় ওকে, রুমাল দিয়ে বার বার মুছিয়ে দেয় গালদুটো।
তারপর, তারপর আর কিছু মনে নেই বর্ণমালার। শুধু মনে পড়ে এরপর আর কোনদিন সে চোখ খুলতে পারেনি। অনুভব করেছে চোখে ব্যন্ডেজ আর তীব্র যন্ত্রণা। বুঝতে পারে যেখানে সে আছে এটা তার বাসা নয়। মাঝে মাঝে চিৎকার করে ‘বাবা’ বলে কাঁদে। কিন্তু কর্কশ কন্ঠের বকুনিতে স্তব্ধ হয়ে যায় ওর কন্ঠ। অনেক শিশুকন্ঠের আহাজারিতে কখনও কখনও ভয়ে কুকড়ে যেত ছোট্ট বর্ণমালা। তবে সেখান থেকে ঠাসাঠাসি করে বসা গাড়িতে চড়ে অন্য আরেকটি জায়গায় চলে এসেছিলো। এখানে এখন আর তেমন অত্যাচার হয়না, শুধু ভিক্ষার টাকার পরিমাণ কম হলে আম্মার চড়-থাপ্পর খেতে হয় মাঝে মাঝে। এখানে শরিফা, মালেকা আরও অনেকে আছে যাদের স্পর্শ সবচে আপন মনে হয়। শরিফাই প্রথম কথা বলেছিলো - কি নাম তোর?
‘‘ বর্ণমালা’’- আস্তে আস্তে উচ্চারণ করেছিলো ও।
- কি মালা? আইচ্ছা যা হউক, মালাই ডাকুম। ডরাইসনা। অখন আর ডরানের কিছু নাই। তোরে ভিক্ষার জইন্য কিইন্যা নিছে আম্মা।
হিম শীতল হাতের স্পর্শ গায়ে কাঁপন ধরালে কেঁপে ওঠে সম্বিৎ ফিরে পায় বর্ণমালা।
‘আরে আমিতো। ইস্ কি জব্বর ঠান্ডা পইরছে। কত পাইলিরে মালা?’ - শরিফার কথায় আশ্বস্ত হয়।
- একটা পাউরুটি পাইছিলাম। খেয়ে ফেলছি। টাকাতো আজ কেউ দেয় নাই। আইজ নতুন জায়গায় বসাইলা ক্যান? একটু একটু ডর করতেছিলো।
মায়া হয় শরিফার - আম্মায় কইছে। আইচ্ছা চল। নতুন জায়গা তাই কিছু পাস নাই। আম্মারে
বুঝাইয়া কমুনে।
শরিফার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওর ভরসা রমাদির কথা মনে করিয়ে দেয়।
- “জানো শরিফাবু আইজ আবার দ্যাখছিলাম সবকিছু ----------”
নতুন করে পুরনো কথা বলতে গিয়ে আবার রূপকথার রাজ্য খুঁজে ফিরে বর্ণমালা। চোখের সামনে তখনও ঘোর অন্ধকার।

-----------------------------------------------------------------------------

১৬/১১/২০০৮

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]