অকস্মাৎ স্বপ্নবাজ

বিকেলের হালকা রোদটুকু বিলীন হয়ে গেছে গাঢ় কালো মেঘের দাপটে। রাস্তার প্যাঁচ প্যাঁচে কাদা স্যান্ডেল ছাড়িয়ে জিন্সের প্যান্টে লেগে যায়। নিউমার্কেটের কাচাবাজারের সামনে দিয়ে আনমনে হাঁটতে থাকে নীর। এখানে এখন রিকশা পাওয়া দুষ্কর। তাই হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ভালোই হলো, ভাবে নীর। রিকশা ভাড়াটা বেঁচে গেলো। পকেটে সঞ্চিত হোক কিছু অর্থ। ভাপসা গরম অস্বস্তির উদ্রেক ঘটায়, বিরক্তির ছাপ পড়ে চোখেমুখে। কিন্তু ছাত্র পড়াতে যেতেই হবে। কিছু টাকা হাতে আসা খুব জরুরী হয়ে পড়েছে ইদানীং। পড়াশোনার খরচ জোগানোর দায়িত্ব খানিকটা হলেও নিজে নিতে না পারলে পরনির্ভরশীল মনে হয় নিজেকে। তাছাড়া তেমন কোন আহামরি সাফল্য তো আর পাওয়া হল না। অন্ততপক্ষে নিজের খরচ চালানোর সন্তুষ্টি নিজেকে সান্ত্বনা দেয় কিছুটা। কাঁচাবাজারের দুর্গন্ধ পেরিয়ে ব্যস্ত মেইন রোডে পা রেখে কিছুটা স্বস্তি পায় নীর। হৈ-হুল্লোড়, দেনা-পাওনার তীক্ষ্ণ শব্দগুলো ক্রমাগত কানে প্রবেশ করছে। তার উপর সজোরে এক নামী ব্যান্ডগ্রুপের গান বাজছে কোন এক ক্যাসেটের দোকানে। চারপাশের মানুষগুলোকে এক পলক দেখে নেয় নীর। মানুষকে পর্যবেক্ষণের মাঝে অন্যরকম একটা মজা খুঁজে পায় সে। বলা যায়, মানুষ দেখা ওর নেশা। কখনও কখনও কাজবিহীন এলোমেলো পায়ে ঘুরে বেড়ায় রাস্তায়, শুধু মানুষ দেখতে। কত যে বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। অল্প পরিসরের মাঝে বিভিন্ন মানুষের মেলা। কেউ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে হাস্যোজ্জ্বল অবয়বে, কেউ ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবসন্ন শরীরে হেঁটে চলেছে শ্লথ গতিতে। কেউ আবার খুব গম্ভীর মুখে চলাফেরা করছে। কোন ভবঘুরে আবার নিজের মাঝে ডুব দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। ব্যস্ত সড়কে দৃষ্টি ফেরায় নীর।

দুটো মেয়ে প্রচন্ড তাড়াহুড়ো করে রোড ক্রস করছে। দুজনেরই সুতি কাপড়ের সেলোয়ার-কামিজ পরনে। তেল দেয়া চুল আটোসাটোভাবে ক্লিপ দিয়ে আটকে ঝুটি করা। নিম্নবিত্ত ঘরের হবে। তারা নীরের দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে হকার্স মার্কেটে প্রবেশ করে। হটাৎ অট্টহাসির শব্দে চমকে দাঁড়ায় নীর। তিন চারটে ছেলে হেসে গড়িয়ে পড়ছে একজন আরেকজনের উপর। ক্যাসেটের দোকানের সামনে বসে আড্ডায় মত্ত। অনেক অনিশ্চয়তার মাঝে জীবনের কিছু মুহূর্তকে উপভোগ করার ক্ষুদ্র প্রয়াসমাত্র। ম্লান হাসে নীর। হয়ত মনে পড়ে এমনিভাবে চুটিয়ে গল্প করার কোন এক মুহুর্ত। বড় রাস্তার পাশে ছোট রাস্তাটি রিকশা চলাচলের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত। এর পাশে ফুটপাত। বড় রাস্তা দিয়ে শো শো শব্দে ছুটে চলেছে বড় বড় গাড়ি, বাস, ট্যাক্সি। আর এই ছোট পথটুকু এত ভার সইতে না পেরে যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। সামনের রিকশাগুলো সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় জটের সৃষ্টি করেছে। পিছনে আটকে পড়া যাত্রী আর রিকশাওয়ালারা অনর্থক চিৎকার করে ক্যালরি নষ্ট করছে। খুব হাসি পেল নীরের। জোরে না হাসলেও হাসির আভাস যে ফুটে রয়েছে ঠোঁট দুটোতে তা বুঝলো এক তরুণীর অবাক চোখের চাহনীতে। কিছুটা বোকা হয়ে নিজেকে সামলে নেয় নীর।

হঠাৎ একটা মিষ্টি কন্ঠ কানে এল, ‘বাপি, জানো আজকে আমি ক্লাসে ‘টাইগার’ স্পেলিং পেরেছি। Tiger হয়েছে না?’
পেছন ফিরে ছোট্ট হাসি হাসলো নীর। তিন চার বছরের ছেলেটা বাবার হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। আর হাতের আইসক্রিম গড়িয়ে পড়ছে কনুই পর্যন্ত। ঝুট-ঝামেলার হাজার বছরের এই পৃথিবীর সবটুকু প্রশান্তি যেন ছেয়ে আছে ওই মায়াবী মুখে। ভাবনাগুলো ছিটকে দূরে সরে যায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়া কোন দিনের খোঁজে। নিশ্চয়তায় ভরপুর দিনগুলোতে যখন ছিল গুটিকয়েক অনিশ্চয়তা। স্পষ্টভাবে স্মৃতিতে ভাসে ছোট্ট নীর বাবার হাত ধরে হেঁটে চলেছে ঢাকা শহরের পথে। ব্যস্ত সড়ক পারাপারে সচেতনতার কোন প্রয়োজন নেই তখন আর। শুধু ‘রেজাল্ট কার্ড’ আর ‘পরীক্ষা’ এ দুটো মহাটেনশন ছাড়া আর কোন চিন্তা ছিল না। অক্ষমতার উপলব্ধি ছিলনা, ছোট ছোট ব্যর্থতাগুলো হঠাৎ কোন হাসির তোড়ে ম্লান হয়ে যেত নিমিষে। সুউচ্চ কাঁচের ভবন কাদা-মাটি ছাড়িয়ে আকাশ স্পর্শ করার উল্লাসে দাম্ভিকতা প্রকাশ করে। আর ক্লান্ত নীর ভাবতে থাকে- এমন কোন কাঁচের দেয়াল ঘেরা বহুতলবিশিষ্ট আভিজাত অফিসে কি কোন সম্মানজনক পোস্ট খালি আছে তার জন্যে। একটা ভবিষ্যৎ চোখে ভাসে, একটা সাফল্যে পরিপূর্ণ মুহূর্ত, মা-বাবার জন্য একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি, একটা ল্যাক্সেরিয়াস লাইফ, একটা সার্থক ক্যারিয়ার। ছোট একটা স্বপ্নের বাস্তবায়ন, একজন বিখ্যাত নাট্যকর্মী হয়ে যাওয়া। একটা চমক, একটা প্রশান্তি নিজেকে প্রমাণ করার। আম্মি আর বাবার অর্থহীন বিবাদের দিন হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়া। আয় আর অতিরিক্ত ব্যয় না হওয়ার দুশ্চিন্তা স্তিমিত হয়ে যাওয়া। হঠাৎ মাস শেষে অর্থের কারণে বাবার টেনশন নিঃশেষ করে দেওয়া।

অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ হর্ণের শব্দ ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় চমকে ওঠা নীরের দূরের ওই জগৎটাকে। অন্যমনস্কভাব পালিয়ে যেতেই স্বপ্নের ঘোর লাগা চোখে ধরা দেয় বর্তমান। আর মাত্র দু-তিনটি বিল্ডিং পেরিয়ে পেস্ট কালারের বিল্ডিংটা। নীরের ছাত্রের ফ্ল্যাট ওখানেই। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় নীর। পাঁচ মিনিট লেট হয়ে গেছে অলরেডি।

---------------------------------------------------------------------------------

২৭/৬/২০০৭

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]