লাশকাটাঘরে আক্কাস আলি

বিবমিষা সৃষ্টি করা দূর্গন্ধের মাঝেও স্বাভাবিকভাবে কাজ করে যায় আক্কাস আলি। কথায় বলে, মানুষ অভ্যাসের দাস। প্রথম প্রথম এই গন্ধে গা গুলিয়ে উঠতো, গন্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে উদরপূর্তির অন্ন বেরিয়ে আসতো। ইদানীং সয়ে গেছে। একটা নতুন লাশের নাভির উপর থেকে চামড়া কাটতে শুরু করে আক্কাস আলি। কাটাকাটির পর ডাক্তার এসে এটা-ওটা দেখে রিপোর্ট লিখবে। বাকি কাজগুলো ডোমদের দিয়েই করিয়ে নেয় ডাক্তাররা।

একপর্যায়ে আক্কাস আলির দৃষ্টি যায় লাশের চোখবোজা মুখমন্ডলে। বাইশ-তেইশ বছরের তরুণী, রক্তশূণ্য অবয়ব দুধসাদা হয়ে গেছে। বাড্ডায় এক পরিত্যক্ত জমি থেকে উদ্ধার করে পোস্টমর্টেম এর জন্য লাশটি পাঠিয়েছে স্থানীয় থানা থেকে। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় লাশের পরিচয় জানা যায় না, তবে এ লাশের পরিচয় পাওয়া গেছে। মেয়েটি নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দা। মা-বাবা, ভাই-বোন কিংবা পরিবারের অন্য কারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। তখনও নাবালিকা ছিল যখন থেকে হাতবদল হওয়ার পর্ব শুরু হয়েছিল ওর জীবনে। তারপর হঠাৎ সেই নিষিদ্ধ পল্লীর আকর্ষণীয় পণ্য হয়ে ওঠা। এসবই পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ডাক্তারের সাথে আলাপের এক পর্যায়ে বলে পুলিশ কর্মকর্তা - ‘একটু দেখে একটা রিপোর্ট দিয়া দেন। ঘটনাতো জানাই, টাকা পয়সা নিয়া এমপির লগে গ্যাঞ্জাম করছে। মনে হয় এমপির পোলাপাইন রেপ কইরা ফালায়া রাইখা গেছে। চাক্ষুস সাক্ষীতো নাই এর উপর কেউ মুখ খুলতেও রাজি না, সামনে আবার নির্বাচনের ঝামেলা। এখন আর এই কেইস আগানো যাইবো বলে মনে হয়না।’
মেয়েটির দু গালে নখের আচড়, হিংস্র দাঁতাল কামড়ের দাগ সর্বাঙ্গে। কিন্তু গলার কাছের ঐ ধূসর কালচে ছোপটা বোধহয় জন্মদাগ। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আক্কাস আলি, এ জায়গায় এই দাগ কোথায় যেন দেখেছিলো।

স্মৃতি-১

আলাপীর মেয়ে পিয়ালী, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, পিয়ালীর গলার কাছে ঠিক এরকম একটা দাগ ছিল। আক্কাস আলির একমাত্র বোন ছিল আলাপী। বিয়ের পর সেকি কষ্ট একটা সন্তানের জন্য, শ্বশুর-বাড়িতে শ্বাশুড়ি, ননদ, জা-এর কত লাঞ্চনা, গঞ্জনা! তারপর আট বছর পার করে ফুটফুটে একটা মেয়ে এল কোলজুড়ে। পিয়ালীকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে একদিন বলেছিলো আলাপী -
‘দেখোনা ভাইজান, আমার চান্দের টুকরা মাইয়াটার গলায় কেমন কালা জনম দাগ। এইটা কি যাইবো না কোনদিন?’
‘নারে পাগলি, জনম দাগ তো সারা জনমের লাইগা। এই দাগ যাইবো না। তাতে কি, চান্দের রূপে দাগ ঢাকা পইড়া যাইবো।’- হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলো আক্কাস আলি।
সেই মেয়েকে একলা বাসায় রেখে বাজারে গিয়েছিলো আলাপী। ফিরে দেখে দরজা খোলা, মেয়ে বাসায় নেই। বারো বছরের মেয়েটিকে বাসায় রেখে প্রায়ই যেত বাজারে কিংবা দোকানে। কোনদিন এমন হয়নি। কিন্তু সেদিন কি হয়েছিলো, হঠাৎ মেয়েটা কোথায় চলে গেল কেউ জানতে পারেনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোথাও পাওয়া যায়নি পিয়ালীকে। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে শ্যামলীর মেন্টাল হসপিটালে কেটেছিলো আলাপীর অবশিষ্ট দিনগুলো।
আচ্ছা, এই মেয়েটার নাম কি পুলিশ ডাক্তারকে বলেছে? সেদিন অসাবধান কোন মুহূর্তে পিয়ালী কি কোন দালালকে দরজা খুলে দিয়েছিল?

আক্কাস আলির গভীর দৃষ্টি নিথর দেহে থমকে দাঁড়ায়। ডান হাতের অর্ধেক অংশজুড়ে যে ক্ষতচিহ্ন তা বহুদিন আগের মনে হয়, প্রায় মিলিয়ে গেছে চামড়ার সাথে। আক্কাস আলিকে কেউ এখন দেখলে ভাবতো ঘোরের মধ্যে আছে সে। ভাবতে থাকে আক্কাস আলি- কতশত ছোটখাট ঘটনা প্রতিনিয়ত শুনতে পাই আমরা। শুনে আনন্দ পাই, কষ্ট পাই কিংবা অনর্থক সহানুভূতি দেখাই। তারপর একসময় ভুলে যাই। কিন্তু মস্তিষ্কের জটিল রসায়ন কী সম্পূর্ণভাবে সব ভুলে যেতে দেয়? দেয়না। তাইতো হঠাৎ কখনও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে টুকরো কথামালা কিংবা কিছু দৃশ্য।

স্মৃতি-২

প্রায়ই সবসময় পূর্ণিমার চাঁদের আকৃতির রঙিন টিপ পরে থাকতো মেয়েটি। অন্তত আক্কাস আলির চোখের সামনে যে কদিন ছিল মেয়েটি তাই দেখেছে সে। ‘এলান পাষাণ আর বজ্জাত ছেলেটার ভাইগ্যে কেন যে আল্লাহ এমুন মাইয়্যা জুটাইয়্যা দিল’- নিষ্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ভাবতো আক্কাস আলি। মুনিয়া, মুনিয়া নাম ছিল মেয়েটির। আক্কাস আলির ভায়রার ছেলের বউ। একেতো গরিব বাপ বিয়েতে তেমন কিছুই দিতে পারেনি মেয়ের সাথে। উপরন্তু জামাইয়ের ব্যবসা লাটে উঠলে নতুন ব্যবসার মূলধন যোগানোর দায়ভার মেয়ের বাপকেই নিতে বলা হয়। এ যেন বিয়ের আগের অলিখিত শর্ত। অসম্ভব ছিল এ শর্ত পূরণ। আর তারপরের ঘটনাতো অহরহ ঘটে এ সমাজের নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত সংসারেও। একদিন নির্যাতনের এক পর্যায়ে উত্তপ্ত বাক্যব্যয়ের জন্য ফুটন্ত গরম পানিতে মেয়েটির হাত ডুবিয়ে দিয়েছিলো ছেলেটা। সেদিন সামনে থেকেও আক্কাস আলি কিছু করতে পারেনি। এটাও হয়ত অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, কোন পরিবারের ব্যক্তিগত মীমাংসায় তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ অনাকাঙ্খিত।
মেয়েটির বাপ কিছুদিন পরে স্ট্রোক করে মরে গিয়েছিল। একদিন মেয়েটিকেও আর পাওয়া যায়নি। যদিও ছেলেটি ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ছাপিয়েছিল এখানে সেখানে; তবু অনেকেরই ধারণা ছেলেটিই হয়ত মেয়েটিকে বিক্রি করে দিয়েছে কোথাও।

লাশটিকে দেখতে দেখতে আক্কাস আলির মন বলে, হয়ত এ মেয়েটিও কোন এক কালে ফুটন্ত গরম পানির স্পর্শের যন্ত্রণা অনুভব করেছে।
কী আবোল তাবোল চিন্তা যে আজ পেয়ে বসলো তাকে।
দ্রুততার সাথে কাজ সারতে মনোনিবেশ করে আক্কাস আলি।
তারমাঝেও চামড়া সেলাই করতে করতে মনের কোণে আরও একটি চেহারা ভেসে ওঠে।

স্মৃতি-৩

পাড়া বেড়ানো, অনবরত বকতে থাকা পাগলী যে কিনা প্রতি বছর গর্ভবতী হত। কখনও কখনও গর্ভপাতে ধ্বংস হত নির্মল সৃষ্টি। আর কখনও ফুটফুটে কোন শিশু জন্ম নিত। কিন্তু সেই শিশুটিকে কদিন পর আর দেখা যেতনা। কোন এতিমখানার লোক, কোন এনজিওকর্মী আর বেশীরভাগ সময় অজানা, অচেনা কোন একজন তুলে নিত শিশুটিকে। এমন কোন শিশুকন্যা ছিল কি এই মেয়েটি?

-‘কি ব্যাপার? এখনও শেষ হয়নি?’
- ডাক্তারের কথায় খানিকটা চমকে উঠে আক্কাস আলি।
‘জানেন স্যার, কত কথা, কত প্রশ্ন যে মনে অয় বেওয়ারিশ লাশ কাটতে কাটতে’ - হাত চালাতে চালাতে বলে আক্কাস আলি।
`ঠিকাছে, এবার একটু সিরিয়াস হয়ে কাজটা শেষ কর।' - ডাক্তারের যান্ত্রিক কন্ঠস্বরে ঢাকা পড়ে আক্কাস আলির আবেগ।
শেষ হয় ময়নাতদন্তের কাজ। হিম শীতল লাশঘরে পড়ে থাকে হয়ত কারও আদুরে কন্যা কিংবা কোন এককালের তরূণী বধূ, প্রাণবন্ত নারী। প্রকৃতপক্ষে একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত পথনারী।

---------------------------------------------------

২৫/১১/২০০৮

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]