জিওল মাছের স্বাদ

চেইন-প্যাডেল ডিঙিয়ে জল যখন সিট ছুঁই ছুঁই তখন ত্রিগুণ ভাড়ার খেপ না নিয়ে আনমনে বসে থাকে গণেশ।

ডুবছে ক্রমশ, প্রথমে ফুটপাত-রাস্তাঘাট-রোড বিভাজক। অতঃপর দোকান-বারান্দা, ঘরদোর, সুউচ্চ ভবনের অলংকার গ্যারেজগুলো। শ শ গাড়ি জলাবদ্ধ, ইঞ্জিনের দাম্ভিকতায় ভাটা পড়েছে।

শহরজুড়ে ‘জল’, আলোড়নে ‘জল’, আড্ডায় ‘জল’, সংবাদপত্রে ‘জল’, চকচকে চ্যানেলগুলোর নিউজের বিশেষ দৃশ্যপটে ‘জল’। দূর্ভোগ পোহানো মানুষ ঘরে ফিরে ‘দূর্ভোগ চিত্র’ দেখে। সস্তা চাদরে ছেঁড়া তোষক ঢেকে, কোন মধ্যবিত্তের ঘরণী গাড়ি অকেজোর রিপোর্টে অবচেতনে খুশী হোন। কেউ তখন জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের পদক্ষেপ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী। ক্রমশ জটিল হতে থাকে তিলোত্তমা নগরীর জল থৈ থৈ ঝঞ্ঝাট।

ঝঞ্ঝাট, চাল-ডাল-তেল-নুনের খিটমিট্ হয়ে আসে। ঝঞ্ঝাট- আমাশয়, সোয়ান ফ্লু, ডেঙ্গু আর দাউদের ঘা হয়ে আসে। এখন ঝঞ্ঝাট ‘জল’ হয়ে এল। এই ঝঞ্ঝাটের তোড়ে মাঝরাতে ভেসে গেল একখান ভাঙা বদনা, ছেলেগুলোর খেলার বশে আস্তাকুড় কুড়োনো প্লাস্টিকের টুকরো, ভাঙা বল, শ্যাম্পু-লোশন-ঝলমলে চুলের রহস্য জুঁই নারিকেল তেলের বোতল। কনডম-কনফ্লেক্স-গুড়ো দুধের মলিন প্যাকেটও।

দু’খন্ড মেঘের আলিঙ্গনে সজোর বজ্রপাত শীৎকারের শব্দ ছাপিয়ে তীব্র হলে, গণেশ দেখে ঘরের আলতো দরজা ডিঙিয়ে হুড়মুড় করে পানি ঢুকছে। বউ তখন ঝটপট শাড়ি গোছায় আর তন্দ্রাচ্ছন্ন ছেলে তিনটিকে ডাকতে থাকে। গণেশ চালের প্যাকেট হাতে তুলে নেবার আগে কোমরে গুঁজে নেয় বাঁশিটি। সেই রাত কাটলে উঁচুতে মাচান বাঁধার পালা, ঘরের উপর ঘর। উদোম গায়ের কচিকাচাদের পানি দাপড়ানো প্রফুল্লতায় ম্লান হেসে, রিকশা নিয়ে বেরোয় গণেশ।

অদ্ভুত এক বিষন্নতা ভর করেছে আজ। ঘিঞ্জি বসত পেরিয়ে কিছুদূর এসে প্যাডেল ঘোরাতে আর ইচ্ছে করে না। এই জল নদী-ঝর্ণা-সমুদ্রে সুন্দর, বন্যার তোড়ে অলুক্ষণে আর নর্দমায় আবর্জনার নামান্তরমাত্র।

আসমান ভাঙা জলের ঢলে শ্যাওলা জমে মনে। কুন্তী মাসির ঘর পেছনে ফেলে, তালুকদারদের বিঘাখানেক জমি ডিঙিয়ে আরও কিছুদূর হেঁটে এসে খুঁজে পাওয়া; নদীঘাটে বেদেবহর। আজকের ঝুম্ বৃষ্টি শ্যামাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বেদে কন্যার দেহের তেরছা বাঁক, চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন নাগিনীর দংশন। ঝড়-জলের সন্ধ্যায় প্রথম কোন রমণীর ভাঁজ খুলতে পারার উত্তেজনা আর প্রবল পাপবোধে আঙুলের রক্তে মাটিভেজা প্রায়শ্চিত্তের খন্ডচিত্র ফিরে ফিরে আসে।

স্মৃতিকাতরতায় ক্লান্ত গণেশ মাঝরাস্তায় কিছু বালকের উল্লাস শোনে। ঠিক বোঝেনা হয়েছেটা কি? এসময় হঠাৎ জটলার মাঝ থেকে ওর বারো বছরের ছেলেটি দৌঁড়ে আসে
-বাপু, বাপু, তুমি এইহানে? বন্যার পানিত্ মাছ ধরা পইরতাছে।

মাছ? হৃদপিন্ডের কোঠরে-শিরায়-উপশিরায় অনুরণিত হয় শব্দটি।
“রিকশায় ওঠ্।”- সজোরে প্যাডেল ঘোরায় গণেশ।

একটা ছোট ট্রাঙ্ক, গেরামের গন্ধ যেখানে আটক। বাবার রঙচটা পাঞ্জাবী, মায়ের পেতলের বালা আরও কত কী সরিয়ে গণেশ বের করে আনে জালটা। এত বছর পর কোন এক অতীত থেকে উঠে আসা আঁশটে গন্ধে আর বাবার ঘর্মাক্ত গায়ের মায়া মায়া গন্ধে অবশ হয় চৈতন্য।

ছেলের হাত ধরে পথে নামে গণেশ, কাঁধে জাল। আগল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ঘুটে কুড়োনী রমনী ভাবে, নিত্যদিনের নগরে এ কোন্ অচিন পদশব্দ আজ।

গাড়ি চলৎশক্তিহীন জলের ঘূর্ণিপাকে। দু’চারটি রিক্সা-ঠ্যালাকে গ্রাহ্য করেনা একদিনের নগুরে ধীবরদল।

ধরা পড়ে তরতাজা ক’টি জিওল মাছ। হৈ-হুল্লোড়ে ভাসে জটলা। কিছু পথচারী শব্দ দূষণে কপাল কুঁচকে বিরক্তির সীমা বোঝায়। কোন কোন পথিক উপভোগ করে রঙ্গমঞ্চের ‘মাছ ধরা’ খেলা। গণেশের ফুলে ফেঁপে ওঠা পেশীতে তখন লেজ ঝাপটানো ‘সুখ’ আটকের প্রবল উত্তেজনা। ঝাঁক ঝাঁক সুখ তখন দুচোখজুড়ে।

ঝাকা প্রায় ফাঁকা, তলানিতে গুটিকতক মাছ। তবুও পূর্বাহ্নে কী এক গভীর সুখবোধ নিয়ে বাড়ি ফেরা।
-বাপু, ঐ মাছ বেচুম না। ঐ মাছ আমার।
-ঐ মাছ যে সব থেইকে চড়া দামে বিকোবে রে। আইচ্ছা, কাইল যে মাছ কবি সেটি তুই খাবি। বেচুম না, হইলো?

ঝকঝকে বিদ্যুৎ খেলানো শরীর যার হাতে ধরা দেয় তার পাতে ওঠেনা। ইলিশের মৌসুমে ডাল-ভাত-উচ্ছো দিয়ে ভাত খেতে খেতে গলার কাছের দলা পাকানো কষ্টটাকেও এক ঢোকে গিলে খায় কিশোর গণেশ। সেই গণেশ ত্রিশ পেরুলো কবে?

“বাজারে চলো বাহে, বন্যাতো দেহি কিছু ট্যাকার জোগান করি দিল।” - মধুর উচ্ছ্বাসে ঘোর ভাঙে গণেশের।
জটলা তখন পানির উল্টো স্রোত ভেঙে হাঁটতে শুরু করেছে। পেছন পেছন দৌঁড়োচ্ছে উল্লোসিত কয়েকটি কিশোর-বালক।

ছেলেটি গণেশকে ঝাঁকায় - বাপু চলো।
“না বাপ, ই মাছ বেচুম না। বাপ-বেটারা মিইলে আজ আয়েশ করি মাছ-ভাত খামু। চল্, বাড়ি চল্।" - গভীর স্বপ্নের ঘোরে কথা বলে গণেশ।
কচি হাত শক্ত করে জাপটে ধরে মাছের ঝাপি
- “কি কও বাপু? আমিন, কৃষ্ণ, চপলের বাপুরা এত্তো ট্যাকা নিয়া বাড়ি ফিরবো, আর আমরা ফিরুম খালি হাতে? কতো ওজনদার মাছ. কত্তো ট্যাকা- এতো ট্যাকা তুমি খাইয়া ফেলতে চাও বাপু?”

আজন্ম আঁশটে গন্ধে লালিত ‘গণেশ হৃদয়’ যোজন যোজন দূরের শহুরে পথশিশুটিকে ঠিক চিনতে পারেনা। কি প্রবল শক্তি ঐ কচি হাতে? গাঁয়ের কোন ধীবর পুত্র শহরের এই জটিল শেকল খুলতে পারেনা।
জটলায় হারিয়ে যেতে যেতে ত্রিশোর্দ্ধো গণেশ আরও একবার ভাবে -
জিওল মাছটির ঝোলমাখা এক লোকমা ভাতের স্বাদ কেমন হতো?

--------------------------------------------

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]