গণি মিয়া বিষয়ক অনধিকার চর্চা

টোস্ট আর অমলেটে সকাল শুরু হয় ল্যাপটপের স্ক্রীনে চোখ রেখেই। ব্যস্ততা কামড়ে ধরতে উদ্ধত, ক্ষতি কি, ব্যস্ততার সাথে এতো বছরের সংসার। গগন চৌধুরী ছুটে চলেন, এমনভাবে ছুটে চলতেই চেয়েছিলেন। ছুটতে ছুটতে ফেলে এসেছেন ধারাপাত, মোরগ লড়াই, ডজনখানেক চিঠি। একসময় নৌকা বাইচের নাম ছিল ব্যস্ততা, এখন ব্যস্ততার নাম সেমিনার - অফিসে কাজের চাপ। হঠাৎ পত্রিকার একটা খবর সকালে খাবার টেবিলের জন্য বরাদ্দ সময়ের খানিকটা বেশিই কেড়ে নেয়; বলা চলে খবর ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করে একটা শব্দ - “জেলিয়াখালি”। কাপ নামিয়ে রেখে আরোও একবার পড়েন গগন চৌধুরী - ‘জেলিয়াখালি’। এরপর উঠে দাঁড়াতেই হয়, নিজে লেট হলে অধস্তনদের লেট করার কৈফিয়ত চাইতে কিছুটা বাঁধে বৈকি।

মনের ভেতর খচখচ করে। গণি মিয়া এখন, এভাবে আসবে কোনদিন ভাবা হয়নি কিনা। কিন্তু জেলিয়াখালি আর গণি মিয়া হুড়মুড় করে একশ একটা ভাবনা-চিন্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঠিক বেরিয়ে এল। কালচে কাচঘেরা গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়েও ভীষণ অসহায় বোধ করেন গগন চৌধুরী।

অফিস পৌঁছে কর্তৃত্ব জাহির করার ইচ্ছে উধাও হয়ে যায়। স্মরণ আজও দেরীতে এসেছে। ছেলেটা এখনও পুরোদস্তুর কামলা হতে পারেনি। ছাত্র-ছাত্র হাভ-ভাবে অপরাধবোধ মায়া জাগায় আজ। টুলে বসে ঝিমাতে থাকা দারোয়ান গলার ঝাঁঝ ছাড়াই সকাল শুরু করলো ভেবে খানিকটা অবাক হয় বোধহয়। নিজের উপর বিরক্তি তেতো করে সকালটাকে।

ভাবনাগুলোকে তুচ্ছ বোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে বার বার। মস্তিষ্কের জটিলতা কাছা দিয়ে লুঙ্গি পরা গণি মিয়াকে বড় বেশি জীবন্ত করে তোলে। প্রায় উলঙ্গ মানুষটিকে দেখতে ভালো লাগছে না গগন চৌধুরীর।

ঢাকা শহরের নিত্যনতুন জায়গাগুলোয় যখন বন-বাদাড়ের ছাপ স্পষ্ট তখন গণি মিয়ার শরীরেও গাঁয়ের গন্ধ। বদলাতে হয় শহরকে, গণি মিয়াকেতো অবশ্যই। গণি মিয়ার গগন চৌধুরী হয়ে ওঠার নির্দিষ্ট কোন তারিখ ছিলনা। তাই কোন দিনের কথা মনে পড়েনা। কোন দিবস পালনের ঝক্কিও থাকেনা কিংবা কোন বিশেষ তারিখ ভুলে থাকার চেষ্টাও করতে হয়না। কিন্তু গণি মিয়া যে কোথাও না কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল - ‘জেলিয়াখালি’ তা জানিয়ে দিল।

চৌকাঠ পেরিয়ে সেই গাছ, তারপর?
তারপর, এক পা.. দুই পা.. তিন পা.. গণি মিয়ার সামনে ধোঁয়াশা। আবছায়ার মাঝে মায়াভরা সেই ডাক - “ও গণি, চাদ্দরখান নে।”

হাড়কাঁপানো শীতেও ইনহেলার কাকে বলে জানাই ছিলনা গণি মিয়ার। বুবুর ডাক তাই সহজেই বাতাসে হারায়। ছুটতে থাকা, ছুটতে ছুটতে শিউলিতলা। প্রতিদিন ঘুমভাঙা চোখে প্রথম কাজ - গামছাভর্তি শিউলিফুল কুড়িয়ে চৌকাঠ পেরোনো সেই গাছের কাছে ফিরে আসা। তারপর আরোও এক পা .. দুই পা .. তিন পা .. ।

কাচের টেবিলে পড়ে থাকা পত্রিকার ওজন বড় বেশি মনে হয় গগন চৌধুরীর কাছে। প্রায় অবশ হাত-এ পত্রিকাতেও খুঁজে ফেরে সেই খবর। সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত। বিধ্বস্ত গাবুরা ইউনিয়নের জেলিয়াখালি।

বুবু কোথায় এখন? চার বছর আগে একবার এসেছিলো, পঁচিশেও সাত-আট এ আটকে থাকা প্রতিবন্ধী ছেলেটিকে সাথে নিয়ে। সম্মানে কমতি না থাকলেও গগন চৌধুরীর ছেলে-মেয়ে দুটোর সাথে একটা দূরত্ব থেকেই যায়। ওদের শহুরে আত্মীয়দের সাথে যেভাবে জমিয়ে বসে আড্ডা দেয়, বুবুর সাথে কোথায় যেন ছেদ পড়ে ওরকম আড্ডায়। গগন চৌধুরী জানেন এই সম্পর্কগুলো এমনই থাকবে। গোবরলেপা উঠোন ছেড়ে কেউ এ ফ্ল্যাটে নিজেকে আগন্তুক ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। আর কেউ কেউ ভাষার দুর্বোধ্যতা ডিঙিয়ে পারেনা অন্তরঙ্গ হতে।

গণি মিয়া যাবে? বাড়িটার কি দশা? কিন্তু গগন চৌধুরীর যে অনেক কাজ জমে আছে, প্রচন্ড ব্যস্ততা। বারকয়েক লাথি-গুঁতো খেয়ে তল্পি-তল্পাসহ মুখ বন্ধে স্বীকৃতি জানানো সেই রঙচটা স্যুটকেস কই হারিয়ে গেছে। সেই সম্বল হাতে করে; বাসে ঝুলে ঝুলে লঞ্চঘাটে যাওয়া- এখন আর চলে না। বদলায় অবস্থান, বদলায় ছোটার ধরণ। ছুটতে হলে হাজারটা কাজ সামলে নিতে হবে। তবুও একবার যেতেই হবে বাড়ি। এক জীবনে একটাই বাড়ি থাকে মানুষের। ম্লান হাসি ফোটে এক বৃদ্ধার কথা মনে ভাসতেই। গণি মিয়ার দাদীজান, বলতেন - যে উঠোনে নাড়ি গাঁথা থাকে সেটাই নাকি ঐ ‘ছাওয়াল’ এর বাড়ি হয়।

কিন্তু আজ গগন চৌধুরী জানেন, নাড়ি গাঁথা না থাকলেও বাড়ি হয়। ছেলে-মেয়ে দুটোর নাড়ি ডাস্টবিনেই ফেলা হয়েছে, তবু ঐ ফ্ল্যাট ওদের একমাত্র আশ্রয়, জন্মসূত্রে ওদের বাড়ি। অথচ ত্রিশ বছর ক্রমে ডালপালা ছড়িয়ে, স্বামী আর বাবা-বাবা খেলার দুর্দান্ত সময় কাটিয়ে আজও ঐ ফ্ল্যাট গগন চৌধুরীর বাড়ি নয়, গণি মিয়ারতো নয়ই।

বাড়ি পড়ে থাকে জেলিয়াখালি। মাকে হারানোর বাড়ি। মাত্র দুবছরের বড় বুবুটার সে বয়সেই গিন্নী হয়ে ওঠার বাড়ি। উঠোনজুড়ে কবিগানের আসরে বাবার মধ্যমণি হয়ে বসে থাকার বাড়ি।

ত্রিশ বছরে যাওয়া হয়েছে বটে দু’বার। দু’বারই নিকানো উঠোনে গিজগিজ করেছে কয়েক গ্রামের মানুষ। একবার উচ্ছ্বাসে, আনন্দে, হৈ হৈ কলরবে বুবু বউ সাজলো। আর একবার ভয়ানক নৈঃশব্দে আসর জমানো মানুষটিকে সবাই গ্রামের গোরস্থানে রেখে এল। সেদিন মানুষগুলোর হাহাকারে গণি মিয়ার মনে হল - বাবার উপর ওদেরই অধিকার বেশি যারা এক ডাকে সব ফেলে পুঁথিপাঠ আর গান শুনতে আসতো।

কিন্তু তার বাড়ির অধিকার কার? কিংবা উঠোনের? চৌকাঠ পেরোনো সেই গাছের... তারপর .. এক পা .. দুই পা .. তিন পা .. মা। বেড়াঘেরা, রোজ রোজ তীব্র মায়ায় শিউলিফুল ছড়িয়ে দেয়া মায়ের কবরের? মা বাড়িতেই থাকতে চেয়েছিলেন। বাড়িতেই থেকে গেলেন।

উঠতেই হয় গণি মিয়াকে। প্রাইভেট কার নিয়েই ছুটতে হয়। বাড়ি ডাকে, নাড়ি ডাকে।

ভাঙা পাকা রাস্তার দুর্ভোগ কাচা রাস্তাকেও হার মানায়। এখানে-সেখানে গর্তে পানি উপচে পড়ছে। গাড়ি এগোয় না। ড্রাইভারের জিম্মায় গাড়ি রেখে পা দুটোও বেশি দূর নিয়ে যেতে পারেনা। অতঃপর নৌকাই ভরসা।

সমস্ত গ্রাম যেন বর্ষার স্পর্শমাখা যৌবনা এক নদী। কোথাও প্রবল ঘূর্ণি নৌকাকে গিলে খেতে চায়। এরই মাঝে গাছ আর বাড়ির ছাত হয়ে টুকরো টুকরো গ্রাম জেগে আছে। গণি মিয়া খোঁজে- গাছ, সম্বল, বাড়ি।

গাইনের (গায়েনের) বাড়ি - মাঝির হাতের ইশারায় থৈ থৈ জলের উপর নড়বড়ে ছাত ভাসে চোখে। গ্রাম সম্পর্কীয় কিছু আত্মীয়ের ছানাপোনারা বসে আছে। ঘরের ছাউনী এখন আশ্রয়।

উঠোন নেই, চৌকাঠ নেই, ঘূর্ণিঝড় উপড়ে নিয়েছে শেকড়। কিন্তু পরবাসী আদুরে খোকাকে ঘর চেনাবে বলে, প্রবল জলের তোড়েও ঠায় দাঁড়িয়ে জননী গাছ।

মাঝি গাছ ছাড়িয়ে সামনে এগোলে শেকড়হীন, উদ্বাস্তু গগন চৌধুরী ওরফে গণি মিয়া যেন আর্তনাদ করে ওঠে - ধীরে চল মাঝিভাই, ধীরে ধীরে ধীরে।
নৌকা এগোয় বড় ধীরে,
এক দাঁড়... দুই দাঁড়... তিন দাঁড়...

-------------------------------------------

১৮/০৩/২০১০

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]