ভাতওয়ালী

মাটির ঢাকনা সরালে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল থেকে ভাপ ওঠা ভাত ভাত গন্ধ ছড়ায়। ঝোলের সমুদ্রে মাংস খুঁজে পাওয়া ভার। ডালের হাঁড়ি পরিপূর্ণ, পাতলা- তবু অতোটা বিস্বাদ নয়। পলাশীর মোড় থেকে এগিয়ে এসে রিক্সা দাঁড় করায় আলম। পরিচিত খদ্দের সৌজন্য হাসির আভা ফুটিয়ে তোলে রুকির মুখে।

সূর্য তখন সবটুকু তেজ নিয়ে মধ্য আকাশে। পরিশ্রমকে দরকষাকষির পাল্লায় তুলে অনেকেই ছুটে আসে এই ফুটপাতের ধারে মধ্যাহ্ন আহারে। কোন ঘর, ঘরণী, এককোণে সাজানো ঘরের লক্ষী চুলো নেই। মূল্যের হিসেব কষে কেউ এখানেই বসে পড়ে চকচকে এক থাল ভাতের সামনে। নিয়মিত খদ্দেরদের চাওয়া একটু বেশি থাকে, কিছুটা আবদারও। দিনমজুর, রিক্সাচালক, ঠেলাওয়ালা, পাঁচমেশালী কাজে উপার্জনওয়ালা পুরুষ, খদ্দের সাধারণত এরাই। তরকারী আর ডালের দাম আলাদা, এক থাল ভাত দশ টাকা। নিয়মিত খদ্দের পাবে একটুকরো কাঁচামরিচ কিংবা পেঁয়াজ, যদি বাজার গরম না থাকে তবেই। কুড়িয়ে পাওয়া পত্রিকার হাতপাখায় রুকির হাতের সোহাগী বাতাস, বাড়তি পাওনা। ওটুকু রুকি নিজে থেকে করে, বড্ড মায়া হয় ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত পুরুষগুলোর জন্যে। কিংবা হয়ত কিছুটা সময় গিন্নী-গিন্নী খেলায় মেতে ওঠে ওর যৈবতী মন।

ফুটপাতের ওপর গণগণে আগুনের উত্তাপমাখা ইটের অস্থায়ী চুলো, হাড়ি-পাতিল, গুটিকতক পানির বোতল - সবই সংসারের সরঞ্জামাদি। কিন্তু এখানে কোন সংসার নেই। রোজদিন দুপুরের প্রারম্ভে পসরা সাজিয়ে বসতে হয় রুকিকে। বিকেলের লালচে আভায় আকাশের যখন লাজরাঙা রঙ তখনও পাওয়া যায় দু-তিনজন খরিদ্দার। এরপর সব গোছানোর পালা। প্রায়ই তখন মনে ভাসে মেয়েবেলার সংসার-সংসার খেলা।

যখন মনে হয় ছোট্ট শিশু-হাত জলরঙে আঁকা সূর্যকে লেপটে দিয়েছে আসমানের গায়ে, তখনই ছিল খেলা সাঙ্গ করার সময়। কখনও উঠোনে শিমের মাচানের পাশে, কখনও মাটির বারান্দায়, জমে উঠতো উচ্ছ্বল ক’টি কিশোরীর জমজমাট মিথ্যে ঘরকন্না।

সময়গুলো তখনকার যখন রুকি বনেদি কৃষক পিতার কন্যা, শহুরে তাচ্ছিল্যের ‘চাষার মাইয়্যা’ নয়। তখনও নদীর যৌবন বাঁধ ভেঙে ওদের জমিন আর উঠোন গিলে খায়নি। চিন্ চিনে ব্যাথায় বুক ভার হলে এককালের স্বপ্নভঙ্গ কোন্ এক অতল থেকে উঠে আসে। এই শহর অনেক দিয়েছে, অনেক নিয়েছে। শহরের ভাগাড়-বস্তিতে মাথা গোজার ঠাঁই দিয়েছে, বাপ মরলে এক গন্ডা ভাই-বোন আগলে রাখতে এই পথ দিয়েছে। এ শহর জোয়ান কৃষকের যৌবনরস চুষে নিয়েছিলো। বাপটা শহরে এসেই বুড়িয়ে গেল।

‘মাটির গন্ধ কই? চাষ নাই, ভিক্ষে করে খাই, এই দোযখে মাটির গন্ধ নাই।’-কোন হতভাগা কৃষকের নাকি ভিক্ষুকের আর্তচিৎকার রুকির ভেতরকে নাড়িয়ে দেয় আজও। মৃত্যুই সকল যন্ত্রণার নিষ্কৃতি -এতোটা ভাল করে বোঝা হয়নি আর কখনও।

একত্রিশের কোঠার আইবুড়ো মেয়েকে কাঁখে-পিঠে বাচ্চা ছাড়াই গ্রহণ করে এ শহর। তৃষ্ণা, গভীর তৃষ্ণা। প্রায়ই ছলকে ওঠে রুকি, বাঁকা হাসি, মাতাল চাহনি, উচ্ছ্বল খুনসুটি। ফুটপাতবাসী কিংবা বস্তিঘরের সংসারী যুবতীরা দেখে - বড় বেহায়াপনায় মেতেছে মেয়েটি।
বস্তির দূর্গন্ধে আতুড়ঘর সাজে কখনও, নবজাতকের চিৎকার জানায় - আরেকটি মুখের অন্ন যোগানোর পালা। রাতের অন্ধকারে খুপড়ি ঘরে রুকি তখন দেখে মুগ্ধ এক তরুণী মা, স্তনদানের স্বর্গীয় অনুভবে বিভোর।

ফুটপাতের খসখসে পাথুরে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বন্যার পুতুল পুতুল মেয়েটা প্রায়ই এগিয়ে আসে ওর দিকে। বুকে তুলে নিতেই খলবল করে ওঠে; হাত-পা ছুড়ে সে কী চাঞ্চল্য! রুকির সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে তখন নরম মাটিতে কুড়োল বসানোর যন্ত্রণা।

কিশোরকালে টলমলে নদীতে গা ভাসিয়ে ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার দিতে দিতে বহুদূর চলে যেতে পারতো। দিগন্ত ছোঁয়ার বড় ইচ্ছে হতো। আজ হঠাৎ খুপড়িতে পড়ে থাকা পক্ষাঘাতগ্রস্ত আতুড় মা, শৈশব-কৈশোরে খেলে বেড়ানো গন্ডাখানেক ভাই-বোনের মুখ ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট হতে থাকে। একটা বৃত্ত, একটা গন্ডি ডিঙিয়ে যাওয়ার সাধ প্রবল হয় ক্রমশ..........

---------------------------------------------

১০/৭/২০০৯

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত [Popular Post]